সিলেটের বহুল সমালোচিত আমিনুল ইসলাম লিটনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। গেল ২২ মার্চ সংগঠিত এই ঘটনা নাটকপাড়ায় সবাই অবগত। কিন্তু এই অঙ্গণে লিটন গ্যাংদের শক্তিশালী ঘাঁটি থাকায় ঘটনার পরও কেউ মুখ খোলছেন না। ঘটনার শিকার ভুক্তভোগী তরুনীর একটি পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি করলেও দায় নেই সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট কিংবা নাট্য পরিষদের। আমিনুল ইসলাম লিটনের একটি ব্যঙ্গ চিত্রের মাধ্যমে শেয়ার করা পোস্টে কমেন্টস অপশনে আরও বিস্ফোরক মন্তব্যসহ তথ্য যুক্ত হয়েছে একাধিক। সেখানে লিটনের বিরুদ্ধে এর আগে ১১ বৎসরের কিশোরী, সহপাঠির মেয়ে, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ একাধিক কিশোরীকে যৌন হয়রানীর অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে।
সিলেটের বহুল আলোচিত আমিনুল ইসলাম লিটন একসময় জাসাস করতেন। সিলেটের শীর্ষ নাট্য সংগঠন কথা কলি’র সদস্যও তিনি। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটেরও তিনি দুইবারের সভাপতি ছিলেন। একইসাথে সিলেট শিশু একাডেমির প্রশিক্ষকের দায়িত্বও পালন করছেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে-আমিনুল ইসলাম লিটনের যৌন হয়রানীর অভিযোগে এর আগে একাধিক অভিভাবক নিজের সন্তানদের শিশু একাডেমি থেকে দূরে রেখেছেন। বিষয়টি স্বীকারও করেছেন সিলেটের প্রবীণ বর্ষিয়ান একজন রাজনীতিবিদ ও অভিভাবক। তিনি জানান, ‘ন’য়ের দশকে নিজের ১০ বছরের কন্য সন্তানকে (বর্তমানে চিকিৎক) শিশু একাডেমিতে ভর্তি করি। সেখানে আবৃত্তির প্রশিক্ষক ছিলেন আমিনুল ইসলাম লিটন। এক পর্যায়ে মেয়েটি সেখানে আবৃত্তির প্রশিক্ষক লিটনের যৌন হয়রানীর বিষয়টি অবগত করলে পরদিন থেকে আমার সন্তানকে একাডেমিতে যাওয়া বন্ধ করে দেই।’ সম্প্রতি লিটনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানীর বিষয়টি সামনে আসলে আরও একাধিক অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। এ বিষয়ে ভোক্তভুগীদের অভিযোগ এবং ক্ষোভ বাড়লেও শিশু একাডেমিতে বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করছেন লিটন।
২০১৯ সালে সিলেটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শতবর্ষকে কেন্দ্র করে স্মরনোৎসব উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন আমিনুল ইসলাম লিটন। স্মরনোৎসব উদযাপনের এক সপ্তাহ আগে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি সম্পর্কে সিলেটের সুশীল সমাজের এক বৈঠকে তিনি বলেন, ‘অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে আসছেন দেশনেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া’। লিটনের এই বক্তব্যের পরই শুরু হয় হৈ-হুল্লুর। অনেকেই বিষয়টিকে কোঁচো কুড়তে কেউটে বলেও উল্লেখ করেন। কতোটুকু জাতীয়তাবাদী প্রেমী হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবর্তে বেগম খালেদা জিয়ার নাম উচ্চারণ করা যায়-এমন প্রশ্নও স্থান পায় আলোচনায়। এরপর লিটনকে রবীন্দ্র স্মরনোৎসব কমিটি থেকে বাদ দেওয়ার দাবিতে সিলেটের আন্দোলন জোড়দার হলেও উৎসব কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয় নি আমিনুল ইসলাম লিটনকে। ভোক্তভোগীরা বলছেন, সেদিনের পর থেকে আজকের আমিনুল ইসলাম লিটন সংস্কৃতি অঙ্গনে আরও বেশি শক্তিশালী এবং একক আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ লাভ করেন।
সেই আমিনুল ইসলাম লিটন এখন পাল্টে ফেলেছেন নিজের অবয়ব। আধুনিক ফ্যাশনের সাথে লম্বা দাড়ি পরিহিত লিটনের বর্তমান চেহারার সাথে মিল নেই ব্যক্তি চরিত্রের। এমনটি জানিয়েছেন-ভোক্তভুগী ওই তরুনী। সৈয়দা ফাইরুজ জেরিন সুবাহ নামের ভোক্তভুগী ওই তরুনী নিজ ফেসবুক আইডিতে এমনটিই উল্লেখ করেছেন। তিনি আমিনুল ইসলাম লিটনকে ইঙ্গিত করে লিখেন-
‘দাড়ি লম্বা করে ফেললেই অতীতে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদেরকে যৌন হয়রানি করা লোকের বেহেশৎ নসিব হয় কি না তা আল্লাহ ভালো জানেন। এখনো গলা উঁচা করে ব্যুলি করার সাহস দেখলে জিহ্বা টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করে। এরা সমাজের মাথা হয়ে যাওয়ায় কেউ কিছু বলে না। পা চাটে। অথবা বাহবা দেয়। সবাই মুখ বন্ধ করে রাখে। কিসের লোভে? আসলে ভয়। প্রানের ভয়। বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাওয়ার ভয়।’
সুবাহ’র ওই পোস্ট শেয়ার করে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন সিলেট জেলা আহবায়ক অধ্যাপক জান্নাত আরা খান পান্না লিখেন, ‘আমি অবিলম্বে ঐ আসামিকে নাট্যাঙ্গনে/ সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সামাজিক বিচারের মুখোমুখি করার জন্য সিলেটের সাংস্কৃতিক সমাজকে আহবান জানাচ্ছি। নতুবা ঐ ব্যক্তিকে সাংস্কৃতিক সমাজ থেকে বহিষ্কার করার জোর দাবি জানাই।’
এদিকে সুবাহ’র পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে যারা এই ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তি দাবি করেছেন, তাদেরকে নিজ নিজ পোস্ট ডিলেট করার মিশন শুরু করেছেন লিটন। এই কাজে সহযোগীতা করছেন লিটনের সহযোগী ৪/৫ জন। এমনকি ভোক্তভুগী তরুণীকেও বিভিন্ন ভয়-ভীতি দেখিয়ে পোস্ট ডিলেটের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছেন বলে প্রাপ্ত অভিযোগে জানা গেছে।
অধ্যাপক পান্না জান্নাতের শেয়ার করা ওই পোস্টে কমেন্টস করে হারুন এ রশীদ মামুন নামক ব্যক্তি লিখেন, ‘আমিনুল ইসলাম চৌধুরী লিটন সাহেবের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ৮ এর দশক থেকে ছিল, এখনও আছে।’ তিনি আরও লিখেন-‘আমিনুল ইসলাম চৌধুরী লিটন নামক ভদ্র (?) লোকের সাথে যাদের উঠাবসা তারা সবাই একই চরিত্রের। তাই এসব তথাকথিত প্রগতিশীলরা এখন মুখে কুলুপ দিয়ে বসে আছেন।’
একই ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে সুবাহ’র পোস্ট শেয়ার করেন প্রবাসী লেখক জেসমিন চৌধুরী। সেখানে শহীদুজ্জামান পাপলু নামের জনৈক ব্যক্তির মন্তব্যে উঠে আসে যৌন হয়রানীর আরও বিস্তর অভিযোগ। তিনি লিখেন, ‘ইনার বিরুদ্ধে মানে আমিনুল ইসলাম চৌধুরী লিটনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন না। আরো অনেকের বিরুদ্ধেই আছে। আপনি দেখেছেন যে, আবৃত্তি শিখতে এসে ১১ বছরের শিশুও সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়েছিলো। তাও অনেক বছর আগে। এতো বছর পরও ১১ বছরের সেই শিশু এখনো ট্রমার মধ্যে আছেন। অথচ, এই ভয়াবহ অপরাধের কোন শাস্তি হয় নাই। ধামাচাপা দিয়া রাখা হইছিলো। লিটন এখন সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি, শহরের দোর্দন্ড প্রতাপশালী একজন সংস্কৃতির মহাজন। নাট্যদল কথাকলির সিনিয়র সদস্য। শুনেছি, অভিযোগের পর লিটন কথাকলি থেকে পদত্যাগ করেছেন। সবকিছু ঠান্ডা হয়ে গেলে এবং মানুষ ভুলে গেলে। তিনি যেনো আবার ফিরে আসতে পারেন। সেই ব্যবস্থা করা হইছে। এইভাবেই সিলেটের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মলেস্টারদের পূনর্বাসন করা হয়।’
জেসমিন চৌধুরীর পোস্টে সিলেটে কথা কলির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিদগ্ধ সংস্কৃতিজন অম্বরিশ দত্ত লিখেন, ‘সম্ভবত আমি একাই এর বা এর সিণ্ডিকেটের বিরুদ্ধে বত্রিশ বছর ধরে কথা বলে গেছি। এদের ছায়াও মাড়াতাম না, ঘটনাচক্রে কোনো অনুষ্ঠানাদিতে পেয়ে গেলে অনুষ্ঠান বর্জন করতাম। অনেক প্রিয় মানুষের চক্ষুশূল হয়েছি এজন্যে। এখনও দেখছি কিভাবে ধামাচাপা দেয়ার মহড়া চলছে। দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায়। সংকট বহুমূখীন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালামের কন্যা আফসানা সালামের পোস্টে জাতীয় বাচিক শিল্পী ও সিলেটের মেয়ে রুপা চক্রবর্তী লিখেন, ‘ছি, ছি ছি ! আমি ধিক্কার জানাই । প্রতিবাদ অব্যাহত থাকুক। আমি দূরে বসেও সঙ্গে আছি।’
বিভিন্ন জনের একাধিক প্রশ্নবানের পর ভোক্তভোগী তরুনী একটি গ্রুপে লিখেন, ‘প্রথমত, ঔ দিন রাতে লিটন আমাকে নিয়ে আমার সামনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে অসভ্য মন্তব্য করেছে। যাকে আমরা বডি শেমিং বলি এবং এটা একটা ভারবাল হ্যারাসমেন্ট। ঔ জায়গা ১০ থেকে ২০ জনের মত মানুষ ছিলো। অতিথি দল ‘প্রাঙ্গণেমোর’ এর সদস্যরাও কয়েকজন মঞ্চে কাজ করছিলেন। কথাকলির কয়েকজন ছিলেন। আমি চিনি না এরকমও বেশ কয়েকজন ছিলেন। লিটন আমাকে মন্তব্য করার পর আমি নিজেই এর জবাব দিয়েছি। আমার সাথে কেউ তখন গলা মিলিয়ে কিছু বলেনি তাকে, আমার মনে হয়েছে বাইরের দলের সামনে সিন ক্রিয়েট না করে বেটাকে যেটুক বলা যায় বলবো। বলেছি। আমি খুবই মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে বাড়ি ফিরেছি এবং আমার ছোটবেলার বন্ধু, যে আবৃত্তি শিখতে গিয়ে ১১ বছর বয়সে লিটন দ্বারা এবিউজড্ হয়েছে তাকে ব্যাপারটা জানিয়েছি, আর কাউকেই আমি জানানো প্রয়োজন মনে করিনি। আমার মাথা ঠান্ডা হওয়ার জন্য আমি লিটনের বিচ্ছিরি একটা স্ক্যাচ্ করতে চেয়েছি এবং তাই করেছি। এরপর যারাই নিজ থেকে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন কি হয়েছে আমি বলেছি। আমি কারো কাছে যেয়ে বলি নাই প্রয়োজন মনে করি নাই। কারন, আমি তো তখন একাই কথা বলেছি, এখন আমার কি প্রয়োজন যেচে যেয়ে গপ্প করার। আর পোস্ট দেখে বুঝে ফেলার পরও যখন কেউ আমাকে সামনে এসে অথবা ইনবক্সে জিজ্ঞেস করছে লোকটা কি লিটন। আমি তো হ্যা বলছি। ’
শিশু যৌন হয়রানীর একাধিক অভিযোগ থাকলেও শিশু একাডেমিতে প্রশিক্ষক হিসেবে বহাল রয়েছেন লিটন। একই অভিযোগে ‘কথাকলি’ থেকে লিটনের বাধ্যতামূলত পদত্যাগের বিষয়টি জানা গেলে না, লিখিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি।
তবে সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সভাপতি রজত কান্তি গুপ্ত জানিয়েছেন, বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন অভিভাবকের ফোন কলের পর কথাকলির সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে-দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয় এবং এরই প্রেক্ষিতে তাকে কথাকলি থেকে পদত্যাগ করতে বলা হয়। তবে কথাকলির সভাপতি শামসুল বাছিত শেরু জানিয়েছেন ভিন্ন কথা! সংগঠনের আমিনুল ইসলাম লিটনের পদবী কি তাও তিনি জানেন না। তাছাড়া পদত্যাগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।
তবে কথাকলি সভাপতির বক্তব্যের সাথে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক শামসুল আলম সেলিম। তিনি বলেন, ‘পদত্যাগ বিষয়টি আমাদের নিশ্চিত করেছেন কথা কলি’র সভাপতি শামসুল বাছিত শেরু।
তিনি আরও বলেন, আমিনুল ইসলাম লিটন বর্তমানে জোটের কোনো দায়িত্বে নন। যেহেতু দুই মাস আগে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়েছে, সে হিসেবে পূর্বের কোনো কমিটি আর গ্রহণযোগ্য হবেন না।
একাধিক শিশুকে যৌন হয়রানীর পর জেলা শিশু একাডেমিতে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা সাইদুর রহমান ভূঞা বলেন, ‘ যেকোনো অভিযোগ আসতে হয় লিখিত আকারে। অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কি হচ্ছে সেটা নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর কোনো কারণ নেই। তবে জেলা প্রশাসকের নির্দেশক্রমে আবৃত্তির প্রশিক্ষক আমিনুল ইসলাম চৌধুরী লিটনকে বর্তমানে সরিয়ে রাখা হয়েছে। ’
ডিআরডি