বিভীষিকাময় ২১ আগস্টের অগ্নিস্বাক্ষী সিলেটের দুই রাজনীতিক যুবলীগের তৎকালীন সিলেট জেলা সভাপতি জগদীশ চন্দ্র দাশ ও সাধারণ সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ। তারা আজো বয়ে বেড়াচ্ছেন বেদনাবিধুর সেই ক্ষণটির স্মৃতি। চারদিকে শুধু নেতাকর্মীদের লাশ আর লাশ। রক্তাক্ত দেহ, রাজপথ- এমন মর্মান্তিক দৃশ্য আজো তাড়া করে তাদের।
২০০৪ সালের ২০ আগস্ট কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সভাপতি বর্তমান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর্জা আজম এমপির আহ্বানে জগদীশ দাশ ও আজাদুর রহমান আজাদ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ঢাকাস্থ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ’র সমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে ঢাকায় যান।
২১ আগস্ট বিকেলে ৪টায় সমাবেশ প্রাঙ্গণে অবস্থান নেয় যুবলীগ। শেখ হাসিনা সমাবেশস্থলে পৌঁছুলে যুবলীগ মিছিলের মাধ্যমে সমাবেশস্থলে বরণ করে নিয়ে আসে নেত্রীকে। ওই মিছিলে প্রথম দিকেই ছিলেন সিলেটের জগদীশ দাশ ও আজাদুর রহমান আজাদ।
এসময় যুবলীগ নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনার অবস্থানের কাছাকাছি স্থানে অবস্থান নেন। সমাবেশে বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে যখন সিলেটের বোমা হামলা ও গুলশানের গ্রেনেড হামলার কথা বলছিলেন, তখন আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ ও সিলেট মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাবেক সিটি মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের নাম উল্লেখ করেন। তিনি এই দুই নেতার উপর গ্রেনেড হামলার বিষয়টি অবতারণা করছিলেন।
এমন সময় হঠাৎ বিকট শব্দে সমাবেশের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে নেত্রীর উপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। এরপর আরো তিনটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সমাবেশস্থল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। উপস্থিত মানুষ প্রাণ নিয়ে যে যেদিকে পারেন গিয়ে আত্মরক্ষা করেন। সমাবেশস্থল হয়ে উঠে মৃত্যুপুরী।
এই পরিস্থিতিতে মানবপ্রাচীর রচনা করেন আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতারা। যে মানবপ্রাচীরে পাশেই ছিলেন জগদীশ দাস ও আজাদুর রহমান আজাদ। তারা মানবপ্রাচীরের ভিতর দিয়ে নেত্রীকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে গাড়িতে তুলে দেন।
সমাবেশস্থলের শুধু লাশ আর লাশ, শতশত নেতাকর্মী আহতাবস্থায় মৃত্যু যন্ত্রণায় রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছেন। এমন বিভীষিকাতে দিশেহারা হয়ে যান জগদীশ দাস ও আজাদুর রহমান আজাদসহ সিনিয়র নেতারা।
তৎকালীন কেন্দ্রীয় যুবলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মিলে হতাহত অনেক লোকজনকে ঢাকায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রেরণ করেন। এরপর জগদীশ দাস ও আজাদুর রহমান আজাদ যখন নিজেদের আবিস্কার করেন তখন দেখতে পান তাদের জামাকাপড় রক্তে লাল হয়ে গেছে।
আহত নিহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর সময় তাদের গায়েও নেতাকর্মীদের রক্তের দাগ লেগে থাকে। সেই রক্তমাখা জামা-কাপড় নিয়েই আহত নিহতের দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান এই দুই নেতা।
ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে গিয়ে তারা দেখেন হাসপাতালে কোনো সিনিয়র চিকিৎসক নেই। সরকার দলের নির্দেশে গ্রেনেড হামলায় হতাহতদের যাতে চিকিৎসা না দেওয়া হয় সে লক্ষে সিনিয়র চিকিৎসকদের হাসপাতাল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ভয়াবহ ও মর্মন্তদ ঘটনার পর হাসপাতালে গিয়েও উপযুক্ত চিকিৎসা মিলেনি।
শিক্ষানবিশ ডাক্তাররা জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকমে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সাহায্যের হাত বাড়ান স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের চিকিৎসকরা। তারা হতাহতদের সেবা দিয়েছেন। জগদীশ ও আজাদ দুইজন গুরুতর আহত ব্যক্তিকে দুই ব্যাগ রক্ত প্রদান করেন।
গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত আইভি রহমান ও সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে দেখতে হাসপাতালেও ছুটে যান সিলেটের এই দুই নেতা।
জগদীশ দাস ও আজাদুর রহমান আজাদ রাজনৈতিক জীবনে বারবার কারাবরণ করেছেন। নির্যাতিত হয়েছেন ভিন্ন মতাদর্শের সরকারগুলোর আমলে। ক্রীড়ানুরাগী আজাদুর রহমান আজাদের উদ্যোগে আয়োজিত টিলাগড়ে একটি ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টেও ছোঁড়া হয়েছিল গ্রেনেড। তবে সেটি অবিস্ফোরিত থেকে যাওয়ায় সে যাত্রায় প্রাণে রক্ষা পান প্রধান অতিথি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, আয়োজক আজাদুর রহমান আজাদসহ অন্যান্য অতিথিবৃন্দ।
ফেসবুকভিত্তিক একটি টকশোতে একুশে আগস্টের ভয়াবহ সেই দিনের কথা স্মৃতিচারন করতে গিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাবেক তিনবারের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এড. মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন আগস্ট মাসে বারবার অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশের উপর আঘাত এসেছে এবং প্রতিটি আঘাত একই সুত্রে গাঁথা। তিনি বলেন জগদীশ ও আজাদ সেই নিকৃষ্টতম ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন জগদীশ চন্দ্র দাস প্রথমে সেই ভয়াবহ হামলার কথা আমাকে ফোনে জানান। পরবর্তীতে আমি আজাদুর রহমান আজাদসহ ঢাকায় অবস্থানরত সিলেটের স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করি এবং হামলায় আহতদেরকে রক্ত যোগাড় করে দিতে বলি।
উল্লেখ্য জগদীশ ও আজাদ দুজনই একাধিকবার নির্বাচিত জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি।