মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের রাজকান্দি রেঞ্জের আদমপুর বন বিটের সংরক্ষিত বন ধ্বংস করে করা হচ্ছে পান জুম। বন বিভাগকে ম্যানেজ করেই স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বেই বনে পান জুমের নামে বন দখল চলছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। ইতিমধ্যে বন বিভাগ অবৈধ পান জুমের পানের চারা তুলে নিলেও কোটি কোটি টাকার বনজ সম্পদ ধ্বংস করার অপরাধে এখনো বিভাগীয় কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
আদমপুর বন বিটের সংরক্ষিত বনের ১৩ হাজার ৮০ একর বন ভুমির বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে কালিঞ্জি কাসিয়া পুঞ্জি। পুঞ্জির সবাই বন বিভাগের বন ভিলেজার। এই ভিলেজার খাসিয়াদের রয়েছে পান বাগান বা পান জুম। দিন দিন বাড়ছে এই পান বাগানের সীমানা। বন বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী বন ভিলেজার মাথা পিছু আড়াই একর জমি ভোগ দখলের কথা থাকলেও প্রত্যেক সদস্য তার দুই থেকে তিন গুণ বেশি দখলে নিয়েছেন। তাদের সেই পান বাগান ঘেষেই সম্প্রতি অবৈধ ভাবে করা হয়েছে পান বাগান। বনের আজবউল্ল্যা,লেটির উপর,হালাই টিলার উপর,কৈতর ও ছোট কেয়ার এলাকায় রোপন করা হয়েছে পানের চারা।
সরেজমিন বন ঘুরে দেখা যায়, কোথাও বনের ন্যাচারেল গাছ-বাশ কেটে বন ধ্বংস করে আবার কোথাও গাছের গোড়ায় লাগানো হয়েছে পানের চারা। স্থানীয়রা জানান, বন বিভাগকে ম্যানেজ করেই পান রোপনের নামে বনের টিলায় টিলায় বন দখলের মহোৎসব চলছে। কয়েক হাজার একর জুরে রোপন করা হয়েছে পানের চারা। স্থানীয়রা জানান, পানের চারা রোপনকালে সামাজিক বনায়নের নামে বনের ওই এলাকায় বাগান করার জন্য ১০ থেকে ৩০ সদস্যের সুফলভোগী কমিটি করা হয়েছে।
এলাকায় গুঞ্জণ রয়েছে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের ইশারা ছাড়া কেউ বনের সামাজিক বনায়ন বা সুফলভোগী বনায়নের কমিটির সদস্য হতে পারেন না। নিজের পছন্দের লোক ছাড়া কেউ স্থান পান না সেই কমিটিতে। কমিটি গঠনের পর বাগান দেওয়ার নামে প্রত্যেক সদস্যের কাছ থেকে নেওয়া হয় ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। জানা গেছে, স্থানীয় চেয়ারম্যানের নামে উপকারভোগী সদস্যদের কাছ থেকে সেই টাকা তুলেন বন বিভাগের সাবেক হেডম্যান কাইয়ুম।
সরেজমিন টাকা নেওয়ার সত্যতা পাওয়া গেলেও উপকারভোগী কেউ মুখ খুলে কথা বলতে রাজি হননি। তারা জানান, এ নিয়ে যে কথা বললে তার উপরই হবে বন বিভাগের গায়েবী মামলা, না হয় চেয়ারম্যান অনুসারীদের হামলা। টাকা তুলার বিষয়ে কথা বলার জন্য বন বিভাগের সাবেক হেডম্যান কাইয়ুমের সাথে যোগাযোগ করা হয়।
কিন্ত তাদের না পাওয়ায় তাদের বক্তব্য জানা যায়নি। আদমপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সাব্বির আহমেদ ভুঁইয়া বলেন,স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আব্দাল হোসেন মনগড়া আইন সৃষ্টি করে বনের জায়গা দেখিয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে স্থানীয়দের দিয়ে পান জুম করাচ্ছেন। তিনি বনকে টুকরো টুকরো করে স্থানীয় লোকদের নামে সামাজিক বনায়নের নামে পান জুম করতে গিয়ে বনের গাছ-বাশ কেটে কোটি কোটি টাকার বনজ সম্পদ ধ্বংস করছেন।
এরা শুধু বনদস্যু নয়? এরা বনকে পুঁজি করে স্থানীয় নিরীহ কৃষকদের প্রতারনার ফাঁদে ফেলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে সাব্বির বলেন, বন বিভাগের সাবেক হেডম্যান আব্দুল কাইয়ুমের মাধ্যমে সামাজিক বনায়ন করে দেওয়ার কথা বলে মাথা পিছু ৪০ হাজার টাকা করে নেওয়ার জনশ্রুতি রয়েছে।
সম্পূর্ণ অবৈধ ভাবে কতিপয় অসাধু বন কর্মকর্তাদের যোগসাজসে স্থানীয় খাসিয়া ও এলাকার নিরীহ লোকজনকে প্রতারণার ফাঁদে পেলে বাগান করে দেওয়ার নামে টাকা নিচ্ছেন। একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যান হয়ে কিভাবে অবৈধ বাগান করেন তা বোধগম্য নয়। আদমপুর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সাবেক ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর মুন্না রানা বলেন,সামাজিক বনায়ন বা সুফলভোগী বাগানের নামে বন দখলের হিড়িক চলছে। স্থানীয় বন বিট কর্নকর্তা ও স্থানীয় চেয়ারম্যান মিলেই বনজ সম্পদ ধ্বংস করে পান বাগাব করা হচ্ছে।
এ নিয়ে কেউ ভয়ে মুখ খুলতে চায় না। কথা বললে হয় বন বিভাগের মামলা না হয় চেয়ারম্যানের অনুসারীদের হামলা। এক প্রশ্নে রানা বলেন,আদমপুর বনে সাহেদ করিমের চেয়েও ভয়ংকর স্থানীয় চেয়ারম্যান। তাকে ছাড়া বনে বন বিভাগের কিছু করার সাহস নেই। স্থানীয় ইউপি সদস্য মোস্তফা মিয়া বলেন,সামাজিক গাছ বাগান করে দেওয়ার নামে এলাকার নিরীহ লোকজনের কাছ থেকে মাথা পিছু ৩০/৪০ হাজার টাকা করে নিয়ে অবৈধ পান বাগান করা হয়। বনের বাঁশ-গাছ কেটে বন ধ্বংস করে পান বাগান করার পর এখন বন বিভাগ পান বাগানের পানের চারা তুলে নিচ্ছে। এই ক্ষতির দায় নিবে কে? তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আদমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দাল হোসেন বলেন, বনের এসব নিয়ে লিখে কি লাভ? ওরা তো আর বন ধ্বংস করছে না। বন নির্ভলশীল হয়ে কেউ যদি বন ধ্বংস না করে
জীবিকা নির্বাহ করার জন্য পান জুম বা বাগান করে থাকেন তা হলেত কারো কিছু বলার নেই। এক প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান আব্দাল বলেন, আমি তো বনের কেউ না তাহলে আমাকে কেনো টাকা দিবে? হেডম্যান কার জন্য টাকা তুলেছে সেটা সে ভালো বলতে পারবে। অপর এক প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি জনপ্রতিনিধি। পাবলিকের পক্ষেই কথা বলাই স্বাভাবিক।
চেয়ারম্যান আব্দাল হোসেন বলেন, যারা অভিযোগ তুলেছেন তারা কারা? অভিযোগের নেপথ্যে কোন স্বার্থসিদ্ধ আছে কিনা তাও দেখতে হবে।আলাপকালে রাজকান্দি ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আবু তাহের বলেন, গহীণ বনের বিভিন্ন স্থানে অবৈধ ভাবে পানের চারা লাগানোর সংবাদ পেয়ে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রোপনকৃত পানের চারা উত্তোলন করে আনা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে রেঞ্জ কর্মকর্তা বলেন, অবৈধ পান বাগান করার নামে পানের চারা রোপনে বিট কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তদন্তক্রমে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এবং যারা বনজ সম্পদ ধ্বংস করেছে তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।