‘কাবাডি’ বা ‘হাডুডু’ আমাদের জাতীয় খেলা।কিন্তু এর জনপ্রিয়তা তেমন একটা নেই।জনপ্রিয় খেলা হচ্ছে ফুটবল।শিশু ও বাল্যকাল থেকেই ফুটবলের সাথে পরিচিত।ছোটো-ছোটো বল পেতাম।ছোটো চাচা দিতেন।এগুলো রাবার বা প্লাস্টিক জাতীয়।কোথা থেকে এনে দিতেন জানা ছিলো না।একটু বড়ো হলে জানতে পারি,কিনে আনতেন।মেলা থেকে কিনতেন।মেলা মানে ‘বিরাট ঘোড়দৌড়’।সাধারণত শীত মৌসুমে আমবাড়ী এলাকায় আয়োজন হতো।বিভিন্ন গ্রামবাসী সম্মিলিতভাবে মেলা আয়োজন করতেন।প্রতিবছর শীতাকালে।অগ্রহায়ণ শেষে এবং চৈত্রমাসের মধ্যবর্তী সময়ে।অনেকটা অবসর সময়ে।অর্থাৎ কামকাজ কম।কৃষি মুলপেশা হওয়ায় ঐসময়ে কাজের চাপ একেবারেই নেই।ফলে এই সময়ে বিনোদন উৎসব হিশেবে আয়োজন করা হতো।ছোটোবড় সবাই মেলায় যেতেন।ঘৌড়দৌড়ের পাশাপাশি নানা রঙবেরঙের পসরা নিয়ে দোকান বসতো।এছাড়া রাতে ‘বায়ান্ন তাস’র কয়েক খেলা এবং ‘তিনঘুটি’ ‘ছয়ঘুটি’ ‘ছরকি’ ও ‘কড়ি’ খেলার আসর জমতো।কোনো-কোনো মেলায় ‘যাত্রাপালা’ অনুষ্ঠান।ফলে রাতদিন জমজমাট মেলা।দিনে ‘ঘোরদৌড়’ এবং রাতে অন্য এক জগত।বেশিদিন আগের কথা নয়।আশির দশকে এমন জমকালো উৎসবসমেত আয়োজন ছিলো।ধারে-কাছের লোক- তো বটেই,দুর-দুরান্ত থেকে লোক সমাগম হতো।মানুষে সয়লাব।ছোটো-ছোটো শিশুরা-আমরা যেতাম।আমাদের আগ্রহের বিষয় ছিলো ‘ঘোরদৌড়’ ও ‘খেলনা’ ক্রয়।এবং বাড়ি ফেরার সময় রকমারি খাবার নিয়ে আসা।ঐ সময়ে প্লাস্টিক-রাবারে ‘বল’ এবং বাঁশি ক্রয় ছিলো অন্যতম।রঙ-বে-রঙের বর্ণিল শৈশব-কৈশোরকাল পার।
মেলার ক্রয়কৃত ‘বল’ দিয়েই খেলার শুরু।কিছুদিন যেতেই টুনকো বল’র আয়ূ শেষ।খেলার চাহিদা পুরণে কোনো-কোনো সময় ‘জাম্বুরা’ দিয়ে ফুটবল খেলতে হতো।জাম্বুরা’র কেতাবি নাম ‘বাতাবি লেবু’।এই ফল দিয়ে বৃষ্টি-ভেজা কর্দমাক্ত মাঠে কতো ফুটবল খেলেছি।এর হদিশ হয়তো গুণে বলা যাবে না।এরপর একটু বড়ো হওয়ার পর বৈশাখ মাসশেষে চামড়ার ফুটবল এবং ‘পাম্পার’ কিনতে হতো।পাড়ার ছেলেরা ধান উঠায়ে জমা করা।এবং ধান বিক্রয় করে ‘ফুটবল’ ও ‘পাম্পার’ কেনা।তাও কিনতে যেতে হতো শহরে।দুরত্ব ছয়-সাত কিলোমিটার হলেও পরিকল্পনা করে যেতে হতো।মাত্র কয়েক কিলো দুর হলেও যেতে হতো নদীপথ বা পায়ে হেঁটে।কী জীবন আমরা অতিক্রম করেছি।এরপরও শহর গিয়ে ক্রীড়া সামগ্রী এনেছি।সম্মিলিত ক্রয় সম্মিলিত খেলা।মেঘ-বৃষ্টির দিনও বাদ নেই।প্রতিদিন বিকেলে খেলা।বাড়ির সামনে বিশাল মাঠ।এই মাঠেই ‘ফুটবল’ খেলায় হাতেখড়ি।ইস্কুল থেকে এসেই বিকেলে খেলা।সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফেরা।হাতমুখ ধুইলে ধও,না হলে নেই।তেমন কড়া নজড় ছিলো না অভিভাবকদের।অতপর ‘হারিকেন’র মিটিমিট আলোতে ঘন্টাখানেক পড়া।আরও একটু সময় গড়ানোর পর দেখি প্রাথমিক বিদ্যালয় ‘স্কুল টুর্নামেন্ট’ হয়।টুর্নামেন্ট আয়োজন হতো ইউনিয়ন ভিত্তিক।বিভিন্ন ইভেন্ট ছিলো;কিন্ত ফুটবল ছিলো না।ছিলো ‘দৌড়’ ‘লম্বা ও উচ্চ লাফ’ এবং অন্যান্য।বছরে একবার আয়োজন হতো।শিক্ষক-শিক্ষার্থী আনন্দ উৎসবে মতো অংশ নেয়া।প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষে হাইস্কুলে ভর্তি।এখানেও বার্ষিক ক্রীড়া এবং ‘স্কুললিগ’ হতো প্রতিবছর।উপজেলা-জেলা পর্যায়ে আয়োজনে অংশ নিতে হতো।এছাড়া এলাকায় বিভিন্ন গ্রামে কিশোরদের মাপের খেলা চালু ছিলো।বয়স ও মাপ ছিলো বিবেচনায়।চোয়ান্ন,ছাপ্পান্ন,আটান্ন ও ষাট ইঞ্চি উচ্চতা এমন কিশোর-যুবদের ফুটবল টুর্নামেন্ট হতো।বিভিন্ন গ্রামের দল-বলসহ এন্ট্রি ফি দিয়ে অংশ নিতো।পুরস্কার ছিলো বাহারি।একধরণের কাঠ ও ধাতু নির্মিত ‘শিল্ড’, খাসি,গরু,ঘড়ি,এমন কী আয়না-চিরুনিও পুরস্কারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকতো।গ্রামে-গ্রামে গিয়ে অংশ নিয়েছি খেলায়।কতো গ্রামে গিয়েছি,খেলেছি, খেয়েছি-এর কোনো হিসাব নেই।পরে একানব্বই-বিরানব্বই বিরামহীন খেলেছি ফুটবল।শুধু নিজের এলাকায় নয়,অন্য অনেক এলাকায় খেলেছি।অনেক আনন্দে-উৎসবে দিন কাটিয়েছি।অনেক সোনাঝরা দিন পার করে এসেছি।মধ্য বয়সশেষে এখন স্মৃতিকাতর হই।স্মৃতি হাতড়াতাতে ভালো লাগে।আহা!বিগত দিনগুলো।
আমাদের কিশোর ও যুব সময়ে নিজেদের ফুটবল নিয়ে মেতে উঠতাম।বিশ্বকাপ খেলার এতো প্রচার ও প্রসার ছিলো না।আমাদের এলাকায় আশির দশকে ইলেক্ট্রিসিটি ছিলো না।ফলে টিভি’র প্রচলনও ছিল না।উনিশশো নব্বই সনে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার কোনো সুব্যবস্থা ছিলো না।খোঁজখবর নিয়ে জানা গেলো আমাদের গ্রামে হিন্দু অধ্যুষিত পাড়ায় টিভি আছে।বাড়ির নাম ‘মথুর’ বাড়ি।ঐতিহ্যবাহী বাড়ি।ঐ বাড়িতে আমাবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের জনপ্রিয় স্যার দীনেশ চক্রবর্তী-দুলু স্যার এবং আমি কোনো একদিন বিকেলে খেলা দেখতে যাই।মূলত স্যারের আগ্রহে যাই।সাদা-কালো টিভিতে খেলা।টিভি আবার চার্জ ব্যাটারি মাধ্যমে চালাতে হতো।কোন্ কোন্ দেশের খেলা ছিলো মনে করতে পারছিনা।সম্ভবত স্লোভেনিয়া বা চেকস্লোভাকিয়া এবং অন্যকোনো দেশ।নাম এখন আর মনে নেই।কীভাবে মনে করবো ‘মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে’।ইহাই আমার প্রথম বিশ্বকাপ দর্শন।প্রথম টিভি পর্দায় খেলা।অন্যরকম এক অনুভূতি!’মথুর’ বাড়িতে একটি খেলাই দেখা হয়।স্যারকে ঘরে ঢুকিয়ে খেলা দেখার সুযোগ দিলেও,আমাকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।আমি ঘরে প্রবেশ করার দরজার সামন থেকে খেলা দেখে ছিলাম।যাই হোক আমার মনে রেখাপাত করে ছিলো বিষয়টি।ফলে আর যাইনি ঐ বাড়িতে খেলা দেখার জন্যে।তখন রেওয়াজ বা কু-সংস্কার ছিলো মুসলিম লোকদের হিন্দু লোকদের বসত ঘরে ঢুকানো হতো না।পরবর্তীতে নব্বই’র বিশ্বকাপ ফাইন্যাল খেলা দেখার জন্যে খোঁজখবর নিতে থাকি।খেলা দেখার অবারিত সুযোগ নেই।শেষমেষ খবর পাই গোবর্দ্বনগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফাইন্যাল খেলার আয়োজন করা হয়েছে।কে বা কারা আয়োজন করেছিলো মনে নেই।মনে হয় তখনকার সময়ের ক্রীড়ামোদীরাই এই অসাধারণ আয়োজন করেছিলেন।আমরা কিশোররা আগ থেকেই হাজির।বিশ্বকাপ চূড়ান্ত খেলা উপভোগ করার জন্যে।অপেক্ষা করছি।একসময় টিভি-ব্যাটারি নিয়ে আয়োজকরা হাজির।টর্চলাইট’র আলো দিয়ে টিভি সেট-আপ করা হলো।আমরা স্কুলের ব্রেঞ্চ-এ বসি।লোকজন ক্রমান্বয়ে আসতে থাকেন।কী রোমাঞ্চকর অবস্থা!ফাইন্যাল হবে আর্জেন্টিনা ভার্সেস জার্মানি।আর্জেন্টিনা’র বিস্ময়কর খেলোয়ার ম্যারাডোনা, অন্যপক্ষে জার্মানির ম্যাথিউস’র দল।খেলা শুরুর আগে দেখা গেলো সবাই আর্জেন্টিনা’র সমর্থক।জার্মানি’র কোনো সমর্থক নেই।দেখলাম জার্মানি’র সাপোর্টার একেবারে শুন্য।আমি তখন নিজেকে জার্মানি’র সমর্থক ঘোষনা করলাম।যদিও আমার ইতোপূর্বে জার্মান বা আর্জেন্টিনা’র খেলা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।উপস্থিত পেক্ষাপট আমাকে জার্মানি’র সমর্থক বানিয়ে দিলো।এখনও সমর্থন বহাল আছে।আমি খেলা পছন্দ করি।আমার মধ্যে খেলা উম্মাদনা নেই।কিন্তু কিছুসংখ্যক খেলা সমর্থকের বালখিল্য উম্মাদনা অনেক সময় হতাশ করে।খেলা উপভোগ করুন,অন্যদের বিরক্ত করে নয়।
লেখকঃ এড. মোহাম্মদ মনির উদ্দিন