বছরের পর বছর একই ঘটনার পূনরাভিত্তির ফলশ্রুতিতে মানুষ হতাশ ও দিশেহারা। সর্বশেষ বঙ্গবাজারসহ আশেপাশে মার্কেট গুলোতে অগ্নিকান্ডের ভয়াবহতা কতটা বেদনাদায়ক এবং মর্মান্তিক তা ভাষায় প্রকাশ করাও কঠিন। মূলত পোষাক ব্যবসায়ীদের জন্য ঈদুল ফিতরের মৌসুম হলো সারা বছরের কেনাকাটা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় উৎসব। এই সময়টাতে ব্যবসায়ীরা যেমন অপেক্ষা করে সারা বছরের দেনা-পাওনা মিটিয়ে আগামী বছর পর্যন্ত স্বাচ্ছন্দে পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার। তেমনি এই সময়টি ব্যবসা প্রসার ও সামাজিক নানান কাজের জন্য বাড়তি আয়ের সুযোগ কাজে লাগিয়ে থাকেন ব্যবসায়িরা। মূলত ব্যবসায়ীরা নিজেদের সামর্থের বাহিরেও আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব থেকে অর্থ সংগ্রহের পাশাপাশি ব্যাংক সেক্টর সহ অন্যান্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করে থাকেন। এমনকি অনেকে নিজের ভিটেমাটি, পারিবারিক গয়না গাটি বিক্রি করেও ভাবিষৎতের স্বপ্ন বুনেন।
মূলত বঙ্গবাজার কেন্দ্রীক ব্যবসার মূল কেন্দ্রীয়তা হলো আমাদের দেশে গড়ে উঠা গার্মেন্টস শিল্পের রপতানির ক্ষেত্রে উৎপাদন বা বন্টনের ক্ষেত্রে যেকোন কারণে অবশিষ্ট হওয়া বা ছোটখাট ত্রæটির কারণে বাদপড়া অথচ তুলনামূলক সস্তায় ব্যবহারযোগ্য পোষাক সামুগ্রীর সমাহার ঘটানো। শুধুমাত্র বাংলাদেশের ক্রেতা সাধারণ নয় বঙ্গবাজার কেন্দ্রীক পণ্যসামুগ্রীর বাজার এই উপমহাদেশ সহ সারা বিশে^র অনেক দেশে এইসকল পণ্যের আলাদা চাহিদা রয়েছে। বঙ্গবাজারের পন্য সামুগ্রী যেমন জাতীয় ক্ষেত্রে অবদান রেখে আসছে, পাশাপাশি বিদেশে এর চাহিদা থাকায় রফতানি বাণিজ্যও এই মার্কেটের ব্যবসায়ীরা যথেষ্ট অবদান রেখেছেন।
প্রতিবছরে ঈদ মৌসুমে পাইকারী ও খুচরা ক্রেতার যে পরিমান সমাগম বঙ্গবাজার ও তার আশেপাশে সমাগম ঘটে তাতে এই বাজারের বার্ষিক লেনদেনের পরিমানের পরিসংখ্যান আমাদের চিন্তার বাহিরে হওয়াই স্বাভাবিক। যদিও সরকারের অর্থনীতি বিভাগ বা ব্যাংকিং সেক্টরের লেনদেনের মোটাদাগের একটা হিসাব পাওয়াই যেতে পারে।
অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের সংখ্যা অনুমান নির্ভর প্রকাশ করা হলেও আমাদের বিবেচনায় তা আরো বেশিই হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এই দোকানীদের সাথে দোকান কর্মচারী, ফড়িয়া ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন কর্মের সাথে জড়িত ক্ষতিগ্রস্তের তালিকা লক্ষাধীকের কম হবে না। এর বাহিরে পরিবার ও পরিতোষক মিলিয়ে কয়েক লক্ষ মানুষের ভরণ পোষণ বঙ্গবাজার কেন্দ্রীক ব্যবসার উপর নির্ভরশীল। গতকালের ঘটনা তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি বিশ^ব্যাপী একটি জটিল সময়ে আমাদের দেশের আরও কয়েক লক্ষ মানুষ জীবন জীবিকার শেষ সম্বল হারিয়ে পথে বসেছে। এই অনাকাঙ্খিত ঘটনার মুখোমুখিতে দেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে যুক্ত হলো আরও একটি বিপর্যয়।
ইতোমধ্যে বঙ্গবাজারের অগ্নিকান্ডের ঘটনা দেশের গণমাধ্যমে যথেষ্ট প্রচার পেয়েছে এবং এই বিষয়টি নিয়ে অনেকেই চুলছেড়া বিশ্লেষণ করবেন এটাই স্বাভাবিক। মোটাদাগে এর দায়িত্ব কারও উপরে চাপিয়ে দেওয়ার অবস্থা আছে বলে আমরা মনে করিনা। কারণ ২০১৯ সালে এই এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদজনক বলে ঘোষণা করা হয়েছে, এমনকি এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সতর্কতার পাশাপাশি ব্যানার ফেস্টুন ঝুলিয়ে এ বিষয়ে দ্রæত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ফায়ার সার্ভিস কর্তৃক প্রচার করা হয়েছে। তাহলে আমরা ধরে নিতেপারি সংশ্লিষ্ট মহলের অসহযোগিতা, উদাসিনতা ও অতিরিক্ত লোভ আজকের ভয়াবহতার পেছনে বড় উপাদান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এছাড়া আমাদের মতো যারা এ সকল মার্কেটে কেনাকাটা করে অভ্যস্ত তাদের অভিজ্ঞতাও কম কোথায়। মার্কেট গুলোতে জনসমাগমের ভিড় যতটা তার অন্যতম কারণ হলো যে গিঞ্জি পরিবেশে এই মার্কেটগুলো তৈরি করা হয়েছে তাতে যে কেউ স্বাভাবিক ভাবে এ ধরণের রোমহর্সক ঘটনার আশংকা করবেন। এই মার্কেটগুলোর ভেতরে যারা কেনা কাটা করেন তারা এক বাক্যে স্বীকার করবেন এসকল মার্কেটের ভেতরে শীত বা গ্রীষ্মকালের ব্যবধান নেই। ১০-১৫ মিনিট মার্কেটে ঘুরাঘুরি করলে অতিরিক্ত ভিড় ও গরমে যে কোন সুস্থ লোক নিমিষেই অসুস্থ বা অস্থির হয়ে উঠবেন দ্রুত বের হওয়ার জন। এই অবস্থা দীর্ঘ সময় থেকে চলে আসলেও অতিরিক্ত আয়ের লোভে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী বা সমিতিগুলো কখনো এর প্রতিকার করার বিষয়ে কখনও উদ্যোগী হয়ে উঠেননি বরং উদাসীন ছিলেন।
একথা সকলে একবাক্যে স্বীকার করবেন, আমাদের দেশে এখনো পরিকল্পিতভাবে বা নিয়ম মাফিক অনেক কিছু গড়ে তোলা সম্ভব হয়ে উঠেনি। খোদ রাজধানীর প্রাণ কেন্দ্রে বঙ্গবাজারের মতো একটি বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অস্বাস্থকর পরিবেশে গড়ে উঠা, বছরের পর বছর হাজার হাজার কোটি কাটার ব্যবসা চালিয়ে আসা এর উদাহরন। মূলত অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা পুরনো ঢাকার ছায়াতলে গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, নিমতলী, সিদ্দিক বাজার এলাকায় এ জাতীয় অনেকগুলো মার্কেট চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আরও কতগুলো বিপর্যয় অপেক্ষা করছে আমাদের সামনে। বিশেষ করে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা নিমতলীতে ২০১০ সালের ভয়াবহ ক্যামিকেল বিস্ফোরণে ১২৪ জন অকালে ঝরে যাওয়ার কথা ভুলা যায় না, এরপর ২০১৯ সালের চুড়িহাটার ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ৭১ জনের করুণ মৃত্যু ও হতাহতের ঘটনা এখনো দুঃস্বপ্নের মতো।
আসলে একটি ঘটনা ঘটার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছুটা তৎপরতা, কড়া-কড়ির উদ্যোগ দেখা গেলেও যে কারণে এই ভয়াবহ ঘটনা ঘটে চলছে তার কোন টেকসই বা স্থায়ী সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়া যায়নি এখনো। ফলশ্রæতিতে বছরের পর বছর খোদ রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শিল্প কল-কারখানা, বাড়ি-ঘরে বিস্ফরণ, অগ্নিদূর্ঘনটা প্রাণহানির মিছিল ঘটেই যাচ্ছে। আসলে বিড়ালের গলায় ঘন্টি বাঁধবে কে?, যারা ক্ষমতাসীন থাকেন তাদের দায়িত্ব সবসময়ই বেশি এটা যটতা ঠিক কিন্তু তার বিপরীতে এই ধরনের অনকাঙ্খিত ঘটনা নিরসনে সামাজিক ও শ্রেণী পেশার মানুষের দায়িত্ব অধিকতর গুরুত্ব বহন করে। ঘটনাগুলো গভীরে গেলে বুঝা যাবে স্থানকাল পাত্র নির্বিশেষ সকলের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থাগত কারণে প্রশাসনের স্বদিচ্ছা থাকা স্বত্তেও ক্ষেত্র বিশেষ দুর্ঘটনা প্রতিরোধের বিষয়ে তড়িৎ কোন ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভবপর হয়ে উঠে না। এমনকি আমলা তান্ত্রিক জটিলতা ও রাজনৈতিক টানাপড়নের কারণে অনেক ক্ষেত্রে এই সকল বিষয়ে স্থায়ী সমাধানের ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া সময় সাপেক্ষ ও দূরহ হয়ে পড়ে। ফলে সময়ের ব্যবধাণে প্রতিটি দুর্ঘটনার পর ধীরে ধীরে তার প্রভাব সমাজ থেকে চাপা পড়ে যায়।
বঙ্গবাজারের ভয়াবহ ও দুর্ঘটনার পর গণমাধ্যমে ফায়ার সার্ভিসের বরাত দিয়ে সারা দেশে বিগত ৫ বছরে ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানে অগ্নিকান্ড সহ দুর্ঘটনার যে খতিয়াণ দেখা গেল তাতে ১৭ হাজার ২ টি দুর্ঘটনায় প্রায় ২৩৬ কোটি টাকার ক্ষতিও ২২জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর থেকে বুঝাই যাচ্ছে শুধুই নিছক ঘটনা নয় এই দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি সামাজিক সংকটের তীর্বতা বৃদ্ধি পায়। পরিশেষে বলা দরকার অনাকাঙ্খিত এসকল দুর্ঘটনা প্রতিরোধে শুধু সিদ্ধান্ত নিয়ে কাগজে বাঘের হিসাব মিলালে চলবে না। জাতীয়ভাবে এসকল অনাকাঙ্খিত ঘটনা কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা নিতে হবে, নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা সকল ভবন, শপিংমল পূর্ণগঠন করতে হবে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক, শ্রমিক ও সমাজে প্রভাব বিস্তারকারী সচেতন নাগরিকদের আরও সজাগ ও সক্রিয় হতে হবে।
লেখক; সালেহ আহমেদ- সাধারণ সম্পাদক, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন।