পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশ ভারত ও চীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ক্রমশ বাড়ছে। কয়েক যুগ শান্ত থাকার পর দুই পক্ষের সেনারা গত ১৫ই জুন লাদাখ সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়ায়। তারপর থেকে উত্তেজনা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং তা বেড়েই চলছে।
সর্বশেষ গত সোমবার রাতে ৪৫ বছর পর লাদাখের একটি অংশে ‘গুলি’ চালানোর ঘটনায় পরস্পরকে দোষারোপ করছে দেশ দুটি।এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতি ঠিক কী ইঙ্গিত দিচ্ছে বিশ্ব রাজনীতিতে? কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে তা? পাঠকের জন্য এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে চ্যানেল আই অনলাইন।
এ প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ‘গত মে মাসের পর থেকে ভারত-চীন দুই দেশই স্থলসীমান্তে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করে যাচ্ছে ক্রমাগত। ১৫ই জুনের সংঘাতে ভারতীয় সৈন্য নিহতের ঘটনার পরে উত্তেজনা প্রশমনে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বেড়েই চলেছে বলা চলে। আমরা যারা বাইরে থেকে দেখছি তাদের কাছেও অবস্থাটাকে চিন্তা উদ্রেককারী বলে মনে হচ্ছে। দুটি দেশের সুসজ্জিত সেনাবাহিনী যখন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেদের দাবি পুনর্উল্লেখ করতে থাকে তখন ওই জায়গাটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে থাকে। এর আগেও এর নেতিবাচক প্রভাব আমরা দেখেছি।’
‘‘দুই দিক থেকেই সেনা অবস্থান সুদৃঢ় করা হচ্ছে। দুই দেশই যতক্ষণে সীমান্ত থেকে আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের সৈন্য নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে না নিচ্ছে ততক্ষণ বিপদের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।’’
তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে ভারত মিডিয়া ও জনগণের মধ্যে চীন সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব প্রকাশিত হচ্ছে। ভারত কিছু চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে, কিছু কাজে চীনাদের অংশগ্রহণে কড়াকড়ি করা হচ্ছে। চীনেও একইভাবে নীতিনির্ধারনী পর্যায়ে ভারতকে অভিযুক্ত করাসহ অনেক কিছু করা হচ্ছে।’
এ রকম উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে এভাবে সুসজ্জিত সেনাবাহিনী পাশাপাশি থাকলে অনিচ্ছাকৃত কিছু দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারে বলেই মনে করেন এই কূটনীতিক। বলেন, ‘বিশ্বাস না থাকলে তো তা আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠে। সম্প্রতি দুটি দেশের বিশ্বাসের জায়গাটা খুবই ক্ষীণ। তাই পরিস্থিতি স্বস্তিকর বলাটা মুশকিল মনে হচ্ছে।’
একই কথা বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন।
তার মতে, ‘গত প্রায় ১ দশক ধরে ভারত ও চীনের মধ্যে বৈরীতা রয়েছে। এখন তারা সীমান্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে, সীমান্তবিরোধ আছে। পুরো বিশ্বেই প্রভাব বিস্তারের একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা আগে থেকেই ছিলো আর এখন এই পরিস্থিতিতে তাদের সম্পর্কের ভেতরে অবিশ্বাস ও বৈরীতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।’
‘‘এখন দুই দেশের সামরিক শক্তি ও কূটনৈতিক শক্তি বেড়েছে ফলে মেরুকরণ তৈরি হয়েছে। দুটি উদীয়মান ও বৃহৎ শক্তিসম্পন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের পরস্পরের সামরিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান দুর্বল করার ও প্রোপাগান্ডা প্রয়োগের চেষ্টা থাকবে। ভারত তার অবস্থান বিষয়ে অনেক প্রচারণা চালানোর ও প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবে একইভাবে চীনও তার চিন্তাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবে।’’
ইরাক আক্রমণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অতীতের অভিজ্ঞতা বা ইতিহাস থেকে আমরা জানি যখন এই ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হয় তখন অনেক তথ্যই ছড়ানো হয়। ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময় যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছিলো ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে।’
‘‘পরে যুক্তরাষ্ট্রই বললো আসলে ওদের কাছে কিছুই নেই। মানে ফলস নিউজ করে আক্রমণ করলো। সেইরকমভাবেই রিয়েলিটি তৈরি করতে নেমেছে ভারত ও চীন। সেজন্যই এই উত্তেজনার সরলীকরণ করা সম্ভব না। অনেকে চীন বিরোধিতা বা ভারত বিরোধিতা থেকেও বিষয়টি দেখার চেষ্টা করে। গভীরে না গেলে এ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না।’’
স্নায়ুযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘সেসময়ে বিশ্ব দেখেছে কতটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। আশেপাশের দেশগুলো এসব বৈরি পরিবেশ মোকাবেলা করে আসছে। সীমান্ত বিরোধের কারণে অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতায় তারা আছে। এসময় তারা অনেক কিছুই করবে। এটা তাদের বিষয়। এতে কারো যদি নিজস্ব স্বার্থের বিষয় না থাকে তাহলে তাতে অন্য কোনো দেশের জড়িয়ে পড়ার কারণ নেই। জড়িয়ে না পড়তে না চাইলেও এই বৈরীতার প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারবে না আশেপাশের দেশগুলো।’
‘‘দুটি বৃহৎ দেশ যখন লড়াই করে তখন তার প্রভাব আশেপাশের দেশগুলোর উপরে পড়ে। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ও তা হয়েছে। নিজেদের কূটনৈতিক দক্ষতা দিয়ে তা মোকাবেলা করতে হবে।’’
বাংলাদেশের জন্য যেমন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে তেমন সুযোগও তৈরি হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চীন ও ভারতের বিষয়ে বাংলাদেশকে অনেক সচেতনভাবে পদক্ষেপ ফেলতে হবে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এক ও দুই নম্বরে। চীন থেকে আমরা অনেক কিছু আমদানি করছি আর ভারত থেকেও অনেক কিছু আমদানি করছি। আবার বাংলাদেশের সঙ্গে দুটি দেশেরই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে অনেক অমীমাংসীত বিষয়, স্বার্থের বিষয় আছে। সেই সব নায্য বিষয়গুলো নিয়ে এখন দরকষাকষি করতে পারে বাংলাদেশ, দেখাতে পারে দৃঢ়তা।’
এমন পরিস্থিতি অনেক দেশ মোকাবেলা করেছে আবার অনেকে লাভবানও হয়েছে জানিয়ে দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই বৈরীতা বাংলাদেশ তৈরি করেনি। দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বন্ধুত্ব ও অংশীদারিত্ব আছে সেগুলো নিয়ে দরকষাকষি করতে পারে। পানি সংকট বা অন্যান্য যেসব সমস্যা ভারত আগেই সমাধান করতে পারতো এখন সময় এসেছে সেগুলো সমাধান করার। অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গেও ভারত সম্পর্ক উন্নয়ন করছে। চীন বাংলাদেশকে যেসব লোন বা অন্যান্য সহযোগিতা দিচ্ছে সেখানে সুদের হার কমিয়ে দেওয়া বা প্রজেক্টগুলো দ্রুত শেষ করার কাজ করতে পারে। এখন বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে।’
‘‘শুধু বাংলাদেশ নয় এই অঞ্চলে আরো অনেক দেশের গুরুত্ব বেড়েছে। মিয়ানমার সুযোগটা গ্রহণ করছে, শ্রীলঙ্কাও সুযোগটা নিচ্ছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শক্তিশালী করেই সেটা অর্জন করতে হবে, তবে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়ে নয় বা সেটাকে ব্যবহার করে নয়। সেজন্য নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও কূটনৈতিক দক্ষতা প্রদর্শন করতে হবে।’’
এই বৈরীতার কতটা প্রভাব পড়বে এই অঞ্চলে বা বাংলাদেশের উপরে- এমন প্রশ্নে হুমায়ুন কবির বলেন, ‘সাক্ষাৎ কোনো প্রভাব হয়তো হবে না। সেসব জনসম্পৃক্ত জায়গা থেকে কিছুটা দূরের বিষয়। কিন্তু ভারত ও চীনের সংঘাত বা উত্তেজনা আমাদের সবগুলো দেশের উপর নানামুখী প্রভাব তৈরি করে। দুটি দেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গেলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশকে কাছে পেতে চায়। আমাদের মতো দেশ যারা দ্বন্দ্বে থাকতে চায় না তাদের জন্য কূটনৈতিক সমস্যা তৈরি করে। দুটি শক্তির মধ্যে সমস্যা তৈরি হলে দেশের বাইরে থেকে ব্যবসা বাণিজ্য, বিনিয়োগ এসব ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।’
উদাহরণ টেনে এই কূটনীতিক বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে আমরা সবাই বিপদগ্রস্ত। এখন খুবই দরকার সবাই হাত মিলিয়ে এই বৈশ্বিক বিপদকে মোকাবেলা করার। এসব প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে পারস্পরিক সহযোগিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। এসব বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবেলায় আমরা কেউই একাই ক্ষমতাধর নই। তাতে সেটা করোনাভাইরাস হোক বা জলবায়ু হোক বা ব্যবসাবাণিজ্য হোক। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া কেউই নয়। একত্রে সমন্বিত উদ্যোগেই তা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।’
‘‘গত ২০ বছরে যারা অনেক কষ্টে দারিদ্রসীমার উপরে উঠে এসেছিলো তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ করোনাভাইরাসের কারণে আবার দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যাবে। তাদের ফেরাতে আমাদের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে হবে। কিন্তু সামরিক সরঞ্জামাদি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ব্যবহার করতে চাইলে তা কর্মসংস্থান তৈরির ব্যবহারে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। করোনাভাইরাসের কারণে অনেকে বেকার হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই কর্মসংস্থানের অভাব, এসব প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে যদি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে যায় তাহলে তা আরো সমস্যা তৈরি করবে।’’
সবশেষে তিনি বলেন, ‘এভাবে আমরা সরাসরি প্রভাবগ্রস্ত না হলেও এই অবস্থা খারাপ দিকে মোড় নিলে বা না নিলেও এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক বা যোগাযোগের বা সামগ্রিক অর্থ এই অঞ্চলে জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের উপর প্রভাব ফেলবে। তাই আমাদের প্রত্যাশা তারা সীমান্তে স্বস্তির উদ্যোগ গ্রহণ করবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছেড়ে জীবনমানের উন্নয়নে মনোযোগ বাড়বে সেটাই প্রত্যাশা।