নীতিমালা, পরামর্শ, সুপারিশের বেশিরভাগই হেলায় পড়ে থাকে-বাস্তবায়ন হয় না। নীতির বাস্তবায়নের এই হেলার ফলে ভয়ংকর বিপদ এগোতে থাকে। আমাদের নীতি নির্ধারক, বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর কর্তাদের কিছু আসে যায় না। তারাও জনগণের অংশ, তারা ভোগান্তি পোহায় –তারপরও তারা জাগে না, জাগতে চায় না। তারা যেন অন্ধ-তাদের চোখ বন্ধ। এই কথাগুলো দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থার বেহাল অবস্থার বেলায়ও বলা যায়। দেশে যোগাযোগ খাতে বড় অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে –কিন্তু গণপরিবহন ব্যবস্থার নীতি এখনো উল্টোপথে হাঁটছে। একজন সাধারণ মানুষও জানেন, বাসে বেশে যাত্রী পরিবহন করা যায়। কিন্তু দেশে বাসের চেয়ে মোটরসাইকেল বেশি,পরিবারে একাধিক প্রাইভেটকার কেনার প্রবণতাও বাড়ছে। তাতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রাস্তায়।
ছোট পরিবহন নিবন্ধনকে নিরুৎসাহিত করে বড় গণপরিবহন নিবন্ধন বাড়াতে হবে। সেটা ঢাকা মহানগরীর জন্য যেমন তেমনি গ্রামীণ এলাকায়ও সেটা জরুরি। কিন্তু দেশ যেন মোটরসাইকেলের ভাগাড় হয়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ৩০ শতাংশ বেশি। এই ঝুঁকি থাকার পরও আজ মোটরসাইকেল বড় বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। তার কারণ বাস ও মিনিবাসের ওপর গুরুত্ব না দেয়া। বড় গাড়ি নামাতে শুল্ক সুবিধা না দেয়া, এমনকি আঞ্চলিক পরিবহন কমিটিতে রুট পারমিট নিয়ে বাণিজ্যের জেরসহ বিভিন্ন কারণে বড় গাড়ি রাস্তায় খুব কম নামছে। তাতে জনপরিবহন ব্যবস্থায় জায়গা করে নিচ্ছে দুই চাকার মোটরসাইকেল। একটি মিনিবাসে যেখানে ২৮ যাত্রী পরিবহন সম্ভব হয় সেখানে মোটরসাইকেলে একজন সহযাত্রী পরিবহন করা যায়। তবুও বাড়ছে মোটরসাইকেল। কিস্তি, ঋণ সুবিধাসহ বিভিন্ন সুবিধায় কেনা যাচ্ছে মোটরসাইকেল। তারুণ্যের শখ মোটরসাইকেলের প্রভাবে এখন বেসামাল হতে চলেছে গণপরিবহন ব্যবস্থা। তা এই গাড়ি নিবন্ধনের পরিসংখ্যানই সাক্ষ্য দেয়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ বিভিন্ন ধরনের নিবন্ধিত গাড়ির পরিসংখ্যান নিয়মিত সংরক্ষন করছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে নিবন্ধিত গাড়ি ৫৫ লাখ ৯২ হাজার ৫৯টি। তার মধ্যে মোটরসাইকেল ৪০ লাখ সাত হাজার ৮১৭টি। তার মানে দেশে মোট নিবন্ধিত বিভিন্ন ধরনের গাড়ির মধ্যে মোটরসাইকেলই আছে প্রায় ৭৮ শতাংশ। অথচ বড় বাস আছে ৫২ হাজার ৪৬টি। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, সারা দেশে মোটরসাইকেল অন্যান্য পরিবহনের চেয়ে বেশি। বিশেষ করে বাসের চেয়ে মোটরসাইকেল নিবন্ধন হচ্ছে অনেকগুণ।
ঢাকা মহানগরী ছোট গাড়ি বিশেষ করে মোটরসাইকেলের চাপে ভেঙে পড়ছে। এই মহানগরীতে নিবন্ধিত বিভিন্ন ধরনের গাড়ি আছে ১৯ লাখ ৫৫ হাজার ৪০৯টি তার মধ্যে মোটরসাইকেল আছে ১০ লাখ ১৫ হাজার ৮৫৪টি। চোখ বন্ধ করে একটু ভাবতে গেলেই চোখ চড়ক গাছ হয়ে উঠে। আর এই অবস্থার কারণ অব্যবস্থাপনা, নীতিমালার বাস্তবায়ন না হওয়া।
প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র, তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে কর্মসংস্থানের বড় সুযোগ; শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সেবা রাজধানীমুখী। ফলে মানুষের মূল স্রোত রাজধানীকেন্দ্রিক। তাই মানুষের যাতায়াতের চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল বাড়ছে। ঢাকার বাইরে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলও এখানে আনা হচ্ছে যাত্রী পরিবহনের জন্য। ভাড়ায় যাত্রী পরিবহনের জন্য এটা করা হচ্ছে। যাত্রীর সঙ্গে চুক্তি করে ভাড়া নিয়ে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। জরুরি দরকারে রাস্তায় বের হয়ে গণপরিবহন না পেয়ে যাত্রীরা বাধ্য হয়ে মোটরসাইকেলে উঠছেন। কয়েকগুণ ভাড়া দিয়ে তবেই মোটরসাইকেলে চড়তে হয়। দেশের গ্রামাঞ্চলেও ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে এ ধরনের বাহনে। তাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে। বিশেষ করে করোনার সংক্রমণের সময় দেশে বহু ব্যক্তি চাকরিহারা হয়ে মোটরসাইকেল ধরেছিলেন। তাদের অনেকে এখনো মোটরসাইকেলে যাত্রী টেনে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তারপরও তা চলছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়ে গেলে পদ্মা সেতুতে তা চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। তিন চাকার বাহন ২২টি জাতীয় মহাসড়কে নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। তারপরও এগুলোর চলাচল কিছুদিন নিয়ন্ত্রিত ছিল। কিছুদিনের ব্যবধানে তা আবার আগের অবস্থায় চলে আসে। ফলে প্রাণহানি বাড়ছে। এক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও নজরদারির অভাব রয়েছে।
দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থায় বাসকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন নীতিমালায় বলা আছে। ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা, আগে প্রণীত জাতীয় স্থল পরিবহন নীতিমালা, বিভিন্ন সেমিনারের ছোট গাড়ি ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করে সুপারিশে বাসের কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ বা বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন বেড়ে যাচ্ছে। তাতে করে সড়কে প্রাণহানিও বাড়ছে। এটা নিয়ত আমরা গণমাধ্যমে দেখে থাকি। নিয়ত তার পরিসংখ্যান দেখে আমরা চমকে উঠি।
পাওয়া তথ্য অনুসারে, বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকা ও এর আশপাশে প্রতিদিন কম হলেও প্রায় দুই হাজার নতুন মুখ (মানুষ) যোগ হচ্ছে। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া মানেই যাত্রী বেড়ে যাওয়া। বাড়তি যাত্রী পরিবহনের জন্য ঢাকায় বাড়ছে গাড়ির চাপ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএর হিসাবে ঢাকায় গত ডিসেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধন হয়েছে ১৯ লাখের বেশি গাড়ি। অথচ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, (রাস্তার তুলনায় গাড়ি চলার হার) রাজধানীর রাস্তায় সর্বোচ্চ দুই লাখ ১৬ হাজার গাড়ি চলতে পারে। বিআরটিএর পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত হয়েছিল পাঁচ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭টি গাড়ি এখন তা ১৯ লাখ ছাড়িয়েছে। সে হিসাবে নিবন্ধিত গাড়ি প্রায় তিন গুণ বেড়েছে এই মেগাসিটিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাড়ির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দ্রুত গণপরিবহন ব্যবস্থা মেট্রো রেল ও বাস র্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটি নির্মাণ করতে হবে। এখন ঢাকা প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যার মহানগরী। ২০৩৫ সালে এখানে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে দুই কোটি ৬৩ লাখে। এই সময়ের মধ্যে মেট্রো রেল নির্মাণ ছাড়াও সড়ক বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে, ঢাকার সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় বা আরএসটিপিতে। বাসে ৫১ জন, মিনিবাসে কমপক্ষে ২৮ জন যাত্রী পরিবহন সম্ভব। কিন্তু প্রাইভেট কারে চালক ছাড়া তিনজন যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব। কম যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হলেও প্রাইভেটকার নিবন্ধন বাসের চেয়ে বেশি।
ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন, সাভার ও কেরানীগঞ্জ ঢাকা মেগা সিটির অন্তর্ভুক্ত। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আয়তন বেড়েছে। আগের আয়তন ১২৯ বর্গকিলোমিটার থেকে বেড়ে হয়েছে ২৭০ বর্গকিলোমিটার। আটটি করে উভয় সিটি করপোরেশনে ১৬টি ইউনিয়ন যোগ হয়েছে। কিন্তু নতুন যোগ হওয়া ১৪১ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে সড়ক বাড়েনি। মূল মহানগরীতে কুড়িল, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, বনানী, জিল্লুর রহমান উড়াল সড়ক, হাতিরঝিল সমন্বিত প্রকল্পের অধীন পূর্ব-পশ্চিমে সড়কসহ কিছু সড়ক বেড়েছে।
সড়ক বাড়লেও গাড়ির চাপ সামাল দিতে পারছে না ট্রাফিক পুলিশ। তীব্র যানজটে ট্রিপ অর্ধেকে নামা, নামকাওয়াস্তে ব্যক্তিনির্ভর পরিবহন ব্যবসা, শিল্প হিসেবে পরিবহন খাতের বিশেষ সুবিধা না পাওয়া, সর্বোপরি এ খাতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ঢাকায় গণপরিবহনের বদলে ব্যক্তিগত পরিবহন বেড়ে ভারসাম্যহীন অবস্থা তৈরি হয়েছে। ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ-ডিটিসিএ-র সমীক্ষ অনুসারে, ঢাকায় গণপরিবহনে প্রতিদিন ২১ লাখ ট্রিপের প্রয়োজন। কিন্তু গণপরিবহনের অভাবে অর্ধেক ট্রিপও দেয়া হয় না। কারণ সড়ক দখলে রাখছে ছোট ছোট গাড়ি। যেগুলো বেশি যাত্রী পরিবহন করে না।
আদর্শ নগরীতে মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকতে হয়। ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। ক্রমেই সংকুচিত নগরীতে জনসংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে যানবাহন। তার মধ্যে ছোট গাড়ি বেড়ে যাওয়ায় যাত্রী পরিবহনের অব্যবস্থায় জনদুর্ভোগ বাড়ছেই। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮-এ মোটরযান নিবন্ধনের সংখ্যা নির্ধারণের বিষয়টি রাখা হয়েছে। তার বাস্তবায়ন নেই।
ঢাকার সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা বা আরএসটিপিতে ঢাকা মহানগরী ও আশপাশে দ্রুত গণপরিবহন ব্যবস্থা নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। মেট্রোরেল ছাড়াও বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলোর কাজ চলছে। এর মধ্যে গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর রুটে বিআরটি নির্মাণের কাজ শেষই হচ্ছে না। কবে শেষ হবে-কে জানে!
আটটি রেডিয়াল সড়ক নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায়। রেডিয়াল সড়ক নির্মাণের কথা রয়েছে ঢাকা-জয়দেবপুর, ঢাকা-টঙ্গী-ঘোড়াশাল, ঢাকা-পূর্বাচল-ভুলতা, ঢাকা-কাঁচপুর-মেঘনা সেতু, ঢাকা-সাইনবোর্ড-নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা-ঝিলমিল-ইকুরিয়া, ঢাকা-আমিনবাজার-সাভার, ঢাকা-আশুলিয়া-ডিইপিজেড অংশে।
ছয়টি এক্সপ্রেসওয়ের মধ্যে রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ চলছে। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ হয়েছে। নির্মাণ করা হবে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-সিলেট এক্সপ্রেসওয়ে ও ঢাকা-ময়মনসিংহ এক্সপ্রেসওয়ে।
ছোট গাড়ি ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে বড় গাড়ির ব্যবহার, সুপারিশ অনুসারে,অবকাঠামো নির্মাণ হলে জনপরিবহন ব্যবস্থা সুশৃঙ্খল হবে। ভোগান্তি কমবে। এখন এ বিষয়ে ভাবার আর সময় নেই। সময় দ্রুত বাস্তবায়নের।