একাধিক ঘটনায় বারবার আলোচনায় শাল্লা হাসপাতালের প্রধান সহকারী নিশিকান্ত তালুকদার। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে গণমাধ্যমে একাধিকবার শিরোনাম হয়েছেন তিনি। তবে এখনও পরিবর্তনহীন তিনি। উপরন্তু দীর্ঘদিনের চাকুরী এবং স্থানীয় হওয়ায় প্রভাব খাটিয়ে শাল্লা হাসপাতালকে সেবার বদলে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করে নিজের আখের গোছাতে ব্যতিব্যস্থ তিনি। নিশিকান্তের এই অবৈধ যাত্রায় কেউ বাধাঁ হয়ে দাঁড়ালে তাকে হতে হয় হুমকীর শিকার। এমনকি নিজস্ব পোষা লোক দিয়ে গণমাধ্যমে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে বাধাদানকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করান তিনি।
এমন অভিযোগ তোলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালেরই একজন কর্মচারী। ওই কর্মচারী জানান, শাল্লা উপজেলার স্বাস্থ্য ও পঃপঃ কর্মকর্তা ডাঃ সেলিনা আক্তার যোগদানের পর থেকেই হাসপাতালের দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে তৎপর হয়ে উঠেন। একই সাথে হাসপাতালকে সেবামুখী করণের লক্ষ্যে সকল প্রকার অনিয়মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেন। ডা.সেলিনা আক্তারের এই উদ্যোগকে হাসপাতালের সৎ ও কর্মনিষ্ট লোকজন স্বাগত জানালেও ক্ষেপে উঠেন আরেকটি পক্ষ। ডা. সেলিনা বিরোধী এই চক্রের মূল নায়ক হলেন বহুল আলোচিত হাসপাতালের প্রধান সহকারী নিশিকান্ত তালুকদার।
হাসপাতালের ৪র্থ শ্রেণীর অপর একজন কর্মচারী নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন,সেলিনা ম্যাডাম শাল্লা হাসপাতালে যোগ দেওয়ার পর থেকে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা বিগত দিনের সকল রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে। তিনি নিজে হাসপাতালে চিকিৎসার তদারকি, সেবা নিতে আসা রোগীদের চিকিৎসা সেবার মান বাড়ানো,অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে কঠোর হোন। মেডিকেলের ডাক্তার,নার্সসহ অন্যান্য কর্মচারীরা সঠিকভাবে দায়িত্বপালন করছেন কিনা তাও সার্বক্ষণিক তদারকি করেন ডাঃ সেলিনা আক্তার। কিন্তু ঘটনা ঘটে তখনই ডা. সেলিনা স্যার যখন ডাক্তার ও নার্সদের আবাসিক ভবনের জন্য নির্ধারিত ২৫% ভাড়া দেওয়ার জন্য নোটিশ প্রদান করেন তখন থেকেই। স্যারের এই সিদ্বান্তে মনোক্ষুন্ন হন হাসপাতালের একটি অশুভ চক্র। এরই প্রক্ষিতে স্টাফদের মধ্যে বিভাজনের ফলে দু’টো গ্রুপ তৈরি হয়। কিন্তু উপজেলার ৫০শয্যা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে সম্পূর্ণরূপে শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন সেলিনা স্যার। স্যারকে দমাতে না পেরে এই চক্র মাষ্টার প্ল্যান করেন ডাঃ সেলিনা আক্তারকে দুর্নীতিতে ফাঁসানোর জন্য । প্ল্যান অনুযায়ী বিভিন্ন ভুয়া বিল ভাউচারে কৌশলে নেওয়া হয় ডাঃ সেলিনা আক্তারের স্বাক্ষরও। পরে তা বিভিন্ন সংবাদকর্মীদের কাছে পাঠানো হয়। সংবাদের পাশাপাশি সচেতন নাগরিকবৃন্দের ব্যানারে স্থানীয় বাসিন্দারা দুটো গ্রুপকে নিয়ে পাল্টাপাল্টি পক্ষে বিপক্ষে মানববন্ধনও করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই চক্রের অশুভ কৌশল হিসেবে ঘুঙ্গিয়ারগাঁও বাজারের একটি ফার্মেসীর ওষুধ ক্রয়ের ৫০হাজার টাকার দু’টি বিল পাওয়া যায়। তাতে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার স্বাক্ষর রয়েছে। তবে ওই ফার্মেসীর প্রোপ্রাইটর মনোহর রায় বলেন, এগুলো নকল ভাউচার। কেউ হয়তো আমার ফার্মেসীর ভাউচার প্যাড নকল করে ব্যবহার করেছে। আর এই স্বাক্ষরও তার নিজের না বলে জানান।
বিলটি ভুয়া এবং এমন বিলে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সিলের বিষয়ে জানতে চাইলে অফিস সহকারী প্রধান নিশিকান্ত তালুকদার বলেন, ‘আমি প্রধান সহকারীর পাশাপাশি হিসাবরক্ষকের দায়িত্বও পালন করছি। এর মধ্যে শনি, রবি,সোমবার শাল্লা হাসপাতাল এবং বুধ ও বৃহস্পতিবার কোম্পানীগঞ্জ হাসপাতালে ডিউটি পালন করি। সুতরাং আমার অবর্তমানে টিএইচও স্যারের আদেশে সেটি উপজেলা কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য পরিদর্শক অসীত বরন দাস করে থাকেন। কিন্তু উপজেলা কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য পরিদর্শক অসীত বরন দাস বলেন, বিল ভাউচার তৈরি করেন অফিস প্রধান নিশিকান্ত তালুকদার। আমার কাজতো হল মাঠে। তাহলে প্রশ্ন হল-ভুয়া বিল ভাউচারে ৫০ হাজার টাকার দুটি চেকের টাকা কি সরকারের গচ্ছা ?
এ ব্যাপারে উপজেলার স্বাস্থ্য ও পঃপঃ কর্মকর্তা ডাঃ সেলিনা আক্তারের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন,ভাউচারগুলো অফিস সহকারী প্রধান তৈরি করেন। আমি শুধু স্বাক্ষর দেই। আমি নতুন এসেছি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীরা যাতে সঠিক সেবা পান ও হাসপাতালের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আমি বদ্ধপরিকর। ডাক্তার, নার্সসহ অন্যান্য স্টাফদের ডিউটি সঠিকভাবে পালন করার ক্ষেত্রে আমি একটু কঠোর। অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমার কঠোর অবস্থান। আমার অপরাধ মনে হয় এখানেই। বিল ভাউচারে কোন অনিয়ম হলে জবাব দিবেন অফিস সহকারী প্রধান নিশিকান্ত তালুকদার। কোনটা আসল কোনটা নকল সেটা তিনি জানেন। কেননা, বিল ভাউচার তৈরি করেন নিশিকান্ত তালুকদার। নিজের সুবিধা মত ডরমিটরিতে বসবাস করতে চেয়েছিলেন তিনি। সেখানে আমার দু’জন গর্ভবতী নার্স থাকেন। আমি উনাকে বললে তিনি তখন ভীষণ ক্ষেপে যান। ডা. সেলিনা আক্তার বলেন, অত্যাচারী চিরকালই ভিরু। সুতরাং কোনো অশুভ শক্তির কাছে নিজের নিষ্টা ও সততা থেমে থাকতে পারে না। সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালের ভাবমূর্তি সচেষ্ট করণে সর্বদাই নিজেকে প্রস্তুত রেখেছি।
নিশিকান্ত তালুকদারের হুমকীর বিষয়টি স্বীকারও করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নার্স ।
কে এই নিশিকান্ত তালুকদার : নিশিকান্ত তালুকদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন নয়। এর পূর্বেও নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রভাব খাটিয়ে নিজের ভাইকে হাসপাতালে চাকুরী দিয়েছেন। ভুয়া বিল ভাউচারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে। এরপরও যুগের পর যুগ নিজ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দাপটের সঙ্গে চাকুরী করছেন তিনি।
এদিকে হাসপাতাল নিয়ে এমন ঘটনায় সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে ৩সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সে মোতাবেক বুধবার (২৭ জুলাই) দুপুরে জেলা থেকে তদন্তে আসেন ৩সদস্য বিশিষ্ট কমিটি।
জেলার সিভিল সার্জন আহমেদ হোসেন শাল্লা উপজেলা স্বাস্থ্য কমল্পেক্সে এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এখন পর্যন্ত দুর্নীতির কোন প্রমান পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য ও পঃপঃ কর্মকর্তা ডাঃ সেলিনা আক্তারের বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে,তাতে তিনি দুর্নীতিতে যুক্ত যে একথা বলা যাবে না। আগের তুলনায় চিকিৎসা সেবার মানও বেড়েছে উপজেলায়। আমরা খুব চেষ্টা করছি শীঘ্রই এখানে সিজারিয়ানের জন্য একটা ব্যবস্থা করার। তবে এখানে প্রক্রিয়াগত কারণে কিছুটা ভুল-ত্রুটি হয়েছে বলে স্বীকার করেন তিনি। আমাদের তদন্ত চলমান, তদন্ত করে যদি কারো অনিয়মের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিবেন বলেও জানান সিভিল সার্জন আহমেদ হোসেন।