অনুষ্ঠানস্থলে নানা রকমের নিজস্ব বাহারি পোশাক পরে এসেছেন আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের লোকজন। গারো জনগোষ্ঠী ছাড়াও অনুষ্ঠানস্থলে এসেছেন বিভিন্ন আদিবাসী জাতিসত্তার লোকজনও। এক জায়গায় গোল করে ঝুড়ির মধ্যে রাখা হয়েছে জমি থেকে তুলে আনা নতুন ফসল, যেগুলো উৎসর্গ করা হবে দেবতাকে। নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিবেশনা আর ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে এভাবেই পালিত হয়ে গেল ফুলছড়া গারো সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী বড় উৎসব ওয়ানগালা।
রোববার (১১ ডিসেম্বর) সকাল থেকে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ফুলছড়া চা বাগানে এই ওয়ানগালা অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজন করেন এখানকার স্থানীয় গারো সম্প্রদায়ের লোকজন। সৃষ্টিকর্তার নামে নতুন ফসল উৎসর্গ করার এ উৎসবে এদিন গারোরা ছাড়াও মেতেছিলেন স্থানীয় বাঙালীসহ নানা জাতী, পেশার মানুষ।
প্রার্থনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ঐতিহ্যবাহী খাওয়াদাওয়ার মধ্য দিয়ে গারো জনগোষ্ঠী উদ্যাপন করে নতুন ফসল ঘরে তোলার উৎসব ওয়ানগালা। উৎসবে নতুন ফসল ঘরে তোলার বিভিন্ন অনুষঙ্গ নৃত্য-গীতের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করা হয় নিজস্ব ঢঙে।
রোববার (১১ ডিসেম্বর) দুপুরে ওয়ানগালা উপলক্ষে আলোচনা সভা হয়। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন শ্রীমঙ্গল ক্যাথলিক মিশনের পাল পুরোহিত ফাদার নিকোলাস বাড়ৈ।
গারো সম্প্রদায়ের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওয়ানগালা গারোদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। ‘ওয়ান’ শব্দের অর্থ দেব-দেবীর দানের দ্রব্যসামগ্রী আর ‘গালা’ অর্থ উৎসর্গ করা। দেব-দেবীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও মনোবাসনার নানা নিবেদন হয় এ উৎসবে।
সাধারণত বর্ষার শেষে ও শীতের আগে নতুন ফসল তোলার পর এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এর আগে নতুন খাদ্যশস্য ভোজন নিষেধ থাকে এ সম্প্রদায়ের জন্য। তাই অনেকেই একে নবান্ন বা ধন্যবাদের উৎসবও বলে থাকেন।
গারোরা নিজেদের ‘আচিক মান্দি’ বা ‘পাহাড়ি মানুষ’ হিসেবে পরিচয় দিতে অধিক পছন্দ করে। তবে সমতলের গারোরা নিজেদের শুধুই ‘মান্দি’ বা ‘মানুষ’ হিসেবে পরিচয় দেয়। গারোদের বিশ্বাস, ‘মিসি সালজং’ বা শস্যদেবতার ওপর নির্ভর করে ফসলের ভালো ফলন। নতুন ফল ও ফসল ঘরে উঠবে, তার আগে কৃতজ্ঞতা জানাতেই হবে শস্যদেবতার প্রতি। গারো সম্প্রদায়ের এটাই নিয়ম। তাই শস্যদেবতাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ও নতুন ফসল খাওয়ার অনুমতির জন্য নেচে-গেয়ে উদ্যাপন করা হয় ঐতিহ্যবাহী ওয়ানগালা উৎসব। একই সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের মঙ্গল কামনা করা হয় শস্যদেবতার কাছে।
ফুলছড়া চা বাগানে ওয়ানগালা উদযাপন কমিটির অন্যতম সদস্যে সামুয়েল হাজং বলেন, দেবতার সন্তুষ্টির পাশাপাশি আমাদের আয়োজনের লক্ষ্য থাকে আমাদের ভাষা-সংস্কৃতিকে জাগ্রত রাখা এবং নতুন প্রজন্মকে এ সম্পর্কে জানানো।
অনুষ্ঠানে আসা শ্রীমঙ্গল নটর ডেম স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ফাদার মৃণাল ম্রং বলেন, ওয়ানগালা গারোদের অনেক প্রাচীন একটি উৎসব। ওয়ানগালা অনুষ্ঠান মূলত অগ্রহায়ণ মাসেই হয়। তখন নতুন ফসল ঘরে ওঠে। গারোরা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করার আগে ‘মিসি সালজং’কে সন্তুষ্ট করতে তাঁকে ডাকত।
গারোরা নতুন ফসল ধান, ফল, সবজি ইত্যাদি ঘরে তুলে নিজেরা খাওয়ার আগে মিসি সালজংকে উৎসর্গ করত। এখন গারোরা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করার পর নতুন ফসল যিশুখ্রিষ্টের নামে উৎসর্গ করে।