এখনও মেয়াদ শেষ হয় নি সিলেট সিটি করপোরেশনের। তবে থেমে নেই নগরপতিরা। নগর ভবনের চেয়ারে বসতে আগ্রহীরা ইতোমধ্যে সরগরম করে তোলছেন পুরো নগর। এই তালিকায় এক এক করে ৮ জনের নাম থাকলেও সম্প্রতি আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর নাম যুক্ত হওয়ায় সিসিকের নির্বাচনী উত্তাপ এখন অনেকটা দৃশ্যমান। এই উত্তাপে বাড়ছে ক্ষোভ, বিভক্তি এবং বাকযুদ্ধ। সিসিক নির্বাচনে সম্প্রতি দলীয় গ্রিণ সিগন্যালের দাবিদার আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর বিপরীতে বাকী ৮ প্রার্থীরা একজোট-এমন বার্তাও ধ্বণিত হচ্ছে। এর আগে সিসিক নির্বাচনে মেয়র পদে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হতে দীর্ঘদিন থেকে মাঠে সরব ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ, সহ-সভাপতি বিজিত চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এটি এম হাসান জেবুল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ, সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আরমান আহমদ শিপলু ও সদস্য প্রিন্স সদরুজ্জামান চৌধুরী।
এদিকে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর ছবি সম্বলিত পোস্টারে শোভাপাচ্ছে নগরীর সর্বত্র। ‘সিসিকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে দেখতে চাই’-এমন শুভ কামনা জানিয়ে জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ,শ্রমিকলীগ ও স্বেচ্ছাসেবকলীগ অধিকাংশ নেতাকর্মীদের নামে সাঁটানো পোস্টার দেখা যাচ্ছে নগরীর অলিতে-গলিতে। এ পরিস্থিতিতে দলীয় পরিবেশ এখন অনেকটাই অশান্ত। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, গেল নির্বাচনে সিলেটে দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ের বিষয়টিও এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হচ্ছে এবং একই সাথে দিনশেষে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর পক্ষে দলীয় পাল্লা আরও বেশি ভারী হয়ে উঠবে।
জানাগেছে, আগামী জুন মাসে সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) মেয়াদ শেষ হচ্ছে। চলতি বছর অক্টোবর মাসের দিকে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে বিএনপির অবস্থান এখনও স্পষ্ট না হলেও দলীয় প্রার্থী নিয়ে নগর আওয়ামী লীগে এক ধরনের টানাপোড়ন শুরু হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে দলের ভেতরে থাকলেও এখন প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে নেতাকর্মীরা।
যেভাবে শুরু বাকযুদ্ধ
সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) সিলেটের স্থানীয় একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। তিনি বক্তব্যের এক পর্যায়ে আনোয়ারাজ্জামান চৌধুরীর ভূঁয়সী প্রশংসা করে বলেন, করোনাকাল থেকে তিনি মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। সুদূর প্রবাসে থেকেও থেমে নেই তাঁর কর্মযজ্ঞ। সময়ে-অসময়ে দেশের মানুষের প্রতি তার মমত্ববোধ ফোটে উঠেছে কর্মের মাধ্যমে। এ সময় তিনি বক্তৃতায় যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামানকে আগামী সিসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী হিসেবে ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। এরপর শুরু হয় তোলপাড়। যদিও এর আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে দলের নগর শাখার সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান প্রসঙ্গে নগরীর ভোটার নন এবং উড়ে এসে জোড়ে আসা লোক বলে উল্লেখ করেছেন।
এদিকে সোমবার দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের বক্তব্যের একদিন পর প্রতিবাদ জানিয়ে মঙ্গলবার (৭ ফেব্রুয়ারি) গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রেরণ করেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ।
যা ছিল বিবৃতিতে
নগর সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হয়-‘এই বিবৃতি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভাজন ও উত্তেজনা ছড়িয়েছে।
বিবৃতিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন সিসিক নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোয়ন নিয়ে দলীয় প্রধানের এমন কোনো নির্দেশনা মহানগরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা পাননি বলে দাবি করেন। দলীয় প্রার্থী নিয়ে তারা নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত না হওয়ারও আহ্বান জানান।
বিবৃতিতে তারা জানান, সোমবার সিলেট সিটি কর্পোরেশনের একটি ওয়ার্ডে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সিসিক মেয়র পদে নির্বাচনের মনোনয়ন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা’র বরাত দিয়ে যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তা মহানগর আওয়ামী লীগের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এ বিষয়ে দুই নেতা ‘সুস্পষ্টভাবে’ জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নিকট থেকে এ সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে তারা পাননি। অতএব ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সিলেট মহানগরের শৃঙ্খলাসহ দলীয় ভাবমূর্তি যাতে বিনষ্ট না হয় এবং বিভ্রান্তি যাতে না ছড়ানো হয় সেজন্যে তারা সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
বিবৃতির বিষয়ে যোগাযোগ করলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী বলেন, তারা (মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক) যে অভিযোগ এনে বিবৃতি দিয়েছেন, এমন কোনো শব্দ আমার বক্তব্যে ছিলো না। সিলেটে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন প্রসঙ্গে আমি কোনো বক্তব্যই রাখিনি। আমি বলেছি, আনোয়ারুজ্জামান বন্যা, করোনাসহ মানুষের সুখে-দুঃখে সব সময় পাশে ছিলেন এবং নেত্রী তাকে কাজ করে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। অথচ তারা কেন এমন বিবৃতি দিলেন, বুঝে উঠতে পারছি না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একজন সহ-সভাপতি বলেন, দলীয় প্রধান জাতির পিতার যোগ্য উত্তরসূরী। তিনি সিলেটের অবস্থা আঁচ করতে পেরে এমন একজনকে প্রার্থী ঘোষণা করতে চান-যাকে মনোননয়ন দিলে দলীয় অবস্থান নড়বড়ে হবে না। সেক্ষেত্রে আনোয়ারুজ্জামান চৌধূরীর দাবি যদি সত্যি হয়, সেটিকে দলীয় প্রধানের অন্যতম একটি কৌশল বলে বিবেচনা করছি। তিনি বলেন, মেয়র পদে যে ৮ প্রার্থী ইতোমধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তাদের মধ্যে যেকোনো একজনকে বেছে নিলে এই বিভাজন আরও প্রকট আকার ধারণ করতো। যারা না বোঝে এই বিভাজনে সুর মেলাচ্ছেন, তাঁরা নিজের পায়ে কুঁড়াল মারছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
দলীয় একটি সূত্রে জানা যায়, আগামী নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী হিসেবে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তাকে ‘গ্রীণ সিগনাল’ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথেও দেখা করেছেন তিনি। এ সময় সিটি নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীও তাকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছেন বলে দাবি আনোয়ারুজ্জামানের।
বাকযুদ্ধ ও নগর আওয়ামী লীগের বিভক্তি বিষয়ে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন,‘ আপনার কথার সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করছি। কারণ নগর আওয়ামী লীগে বিভক্তি থাকলে প্রতিদিন আমার গণ সংযোগে এতো সদস্য সম্পৃক্ত হতেন না। তাছাড়া জেলা আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনের সকল শ্রেনীর নেতাকর্মী আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন।’ তিনি বলেন, দল এবং ব্যক্তির মধ্যে বিস্তর ফারাক। সুতরাং কারো ব্যক্তি অভিমত কখনোই দলীয় হতে পারে না। তিনি বলেন, যেখানে নির্বাচনের তপশীল এখনও ঘোষণা হয় নি, সেখানে নগর শাখায় লিখিত কোনো নির্দেশনা আসার সুযোগ নেই।
এ ব্যাপারে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন বলেন, এসব (প্রার্থিতা) বিষয়ে দলীয় কোনো নির্দেশনা এখনো পাইনি। এখানে আমিসহ আরো কয়েকজন সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছি। সবাই কাজ করছি। তিনি (আনোয়ারুজ্জামান) নতুন মনোনয়নপ্রত্যাশী। তবে দল যাকে প্রার্থী করবে, তার পক্ষেই আমরা সবাই কাজ করব।