বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ৯৫তম জন্মবার্ষিকী

নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জুলাই ২০২০, ২:৩২ পূর্বাহ্ণ
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক তাজউদ্দীন আহমদের ৯৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটি লেখা দেওয়ার জন্য যখন আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত একজন সাংবাদিক বন্ধু অনুরোধ করলেন, আমি তখন চিন্তায় পড়ে গেলাম। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর মানুষ যখন করোনাভাইরাস মহামারিতে দিশাহারা, যখন অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে সবাই অনেকটা বিপর্যস্ত, যখন ভবিষ্যতের পথটা অনেকটাই অন্ধকার, ঠিকসেই মুহূর্তে কী লিখতে পারি আমার বাবা সম্পর্কে? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল ৪৩০ খ্রিস্টপূর্ব এথেন্সের কথা।সে বছর এথেন্স আক্রান্ত হয় ভয়াবহ ‘প্লেগ’ মহামারিতে।ওদিকে তখন আবার ওদের যুদ্ধ চলছিল স্পার্টার সঙ্গে (পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধ), যা থেকে আত্মরক্ষার জন্য সব মানুষ শহরের দেয়ালঘেরা কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়। তাতে হয় হিতে বিপরীত, এই ভয়াবহ ছোঁয়াছে রোগ আফ্রিকার ইথিওপিয়া থেকে এসে এথেন্সে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় এথেন্সের নেতৃত্বে ছিলেন পেরিক্লেস, যাঁর নেতৃত্বে ৪৬১ খ্রিস্টপূর্ব থেকে পেরিক্লেসের নেতৃত্বে এথেন্সের ব্যাপক উন্নতি হয়। ইতিহাসবিদরা সেই সময়কে আখ্যায়িত করেছেন ‘পেরিক্লেসের যুগ’ নাম দিয়ে। কিন্তু মহামারি ছারখার করে দেয় সব কিছু, মৃত্যু ঘটে শতকরা ২৫ শতাংশ মানুষের, এমনকি পেরিক্লেস নিজেও মারা যান ৪২৯ খ্রিস্টপূর্বে। যুদ্ধ চলে আরো ২৫ বছর। এতে পুরোপুরিই বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার কথা এথেন্সের। কিন্তু এর পরও ঘুরে দাঁড়ায় তারা। প্রশ্ন হচ্ছে যে এত বিপর্যয় আর প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও কিভাবে তারা দৃঢ়তার সঙ্গে ভবিষ্যেক মোকাবেলা করতে এগিয়ে চলল? কেন তারা পরাজয় মেনে নিল না?
এর কারণ জানতে হলে বিশ্লেষণ করতে হবে তাদের সামাজিক মূল্যবোধ এবং জীবন বা জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের চিন্তাধারা। তারা ছিল গর্বিত জাতি, তাদের গর্ব ছিল তাদের ইতিহাস, তাদের গর্ব ছিল ব্যক্তিস্বাধীনতার ইতিহাস, মুক্তচিন্তা-বাক্স্বাধীনতার ইতিহাস, গণতন্ত্রের ইতিহাস, ভাষা-সাহিত্যের ইতিহাস, যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ইতিহাস, উন্নত সংস্কৃতির ইতিহাস। তাদের অনুপ্রেরণা ছিল সেই ইতিহাসের চরিত্ররা, যাঁদের দিয়ে তৈরি হয়েছিল সেই গর্বিত ইতিহাসের অধ্যায়।আজ থেকে প্রায় দুই হাজার পাঁচ শ বছর আগে কেমন ছিল আমাদের এই পৃথিবী?
বর্তমান যুগে বাক্স্বাধীনতা, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, সম-অধিকার ইত্যাদি আমরা আমাদের প্রাপ্য অধিকার হিসেবে ধরে নিয়েছি, কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যখন একজন মানুষের সামাজিক অবস্থান নির্ধারিত হতো তার জন্ম থেকেই—হয় রাজা নয়তো প্রজা। নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করার কোনো সুযোগ ছিল না। সেই সময় ভারত উপমহাদেশে ছিল রাজাদের রাজত্ব, মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল পারস্য সাম্রাজ্য, মিসরে ফারাওদের রাজত্ব, বাদ বাকি আফ্রিকা তখনো সভ্যতার ছোঁয়া পায়নি। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় তখন আদি মায়ান রাজত্ব এবং ছড়ানো-ছিটানো আদি মানুষ। বাকি ইউরোপের বেশির ভাগ মানুষ ছোট ছোট গোষ্ঠী দ্বারা ন্যূনতম জীবন যাপন করছে। চীন দেশে জু বংশের রাজত্ব। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে শুধু আদিবাসীদের বসবাস। এমন অবস্থায় এথেন্সে ঘটে যায় যুগান্তকারী কিছু ঘটনা, যা চিরকালের জন্য পাল্টে দেয় মানুষের ভবিষ্যৎ চলার পথ
এথেন্সের কাহিনি থেকে জানা যায়, ৫৬১ খ্রিস্টপূর্বে সেই শহরে ব্যাপক অশান্তি হয়, যার কারণ ছিল সেই সময়ের ক্ষমতাবান অভিজাত পরিবারের শাসকগোষ্ঠীর অন্তর্দন্দ্ব, অত্যাচার ও নির্যাতন। এর থেকে রেহাই পেতে যখন এথেন্সবাসী দিশাহারা, ঠিক তখন পাইসিসট্রাটাস নামের একজন শক্তিধর সুদর্শন ব্যক্তি হাজির হন এবং এথেন্সবাসীকে এই দুর্যোগ থেকে মুক্তিদানের প্রতিজ্ঞা করেন। এথেন্সবাসী তাঁকে গ্রহণ করে নেয় এবং পাইসিসট্রাটাস প্রথম ‘টাইরান্ট’ অর্থাৎ স্বৈরশাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞা অটুট রাখেন এবং সাধারণ মানুষের জীবন উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্যাপক কাজ করেন। পাশাপাশি অভিজাত গোষ্ঠীর ক্ষমতা ও প্রভাব অনেকটাই কমিয়ে আনেন। পাইসিসট্রাটাসের নেতৃত্বে এথেন্সের অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি হয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এথেন্স বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। এই সময় সামাজিক পরিবর্তনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল মেধা ও যোগ্যতা। যেকোনো পেশা বা কাজে মেধা আর যোগ্যতাই ছিল সমাজে একজন নাগরিকের সবচেয়ে বড় পরিচয়। আর এই দুইয়ের প্রতিযোগিতাই হয়ে ওঠে সমাজের মূলমন্ত্র বা চালিকাশক্তি।
৫২৭ খ্রিস্টপূর্বে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই দুই ছেলেসন্তান হিপ্পিয়াস ও হিপ্পার্কাস যৌথভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। প্রথম দিকে তাঁরা বাবা পাইসিসট্রাটাসের পথ অবলম্বন করেন, কিন্তু ৫১৪ খ্রিস্টপূর্বে হিপ্পার্কাসকে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করলে তাঁর ভাই হিপ্পিয়াস প্রতিশোধের নেশায় মগ্ন হয়ে যান এবং ষড়যন্ত্রকারীদেরসহ অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা ও নির্যাতন করেন। এর ফলে এথেন্সের জনগণ তাঁর বিপক্ষে চলে যায় এবং একক শাসকচালিত প্রথার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। অভিজাত পরিবারতন্ত্রের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে তারা সেই পদ্ধতিও প্রত্যাখ্যান করে। গড়ে ওঠে জনতার আন্দোলন এবং ৫১০ খ্রিস্টপূর্বে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার হিপ্পিয়াসের পতন ঘটলে তাঁকে এথেন্স থেকে প্রবাসে বিতাড়িত করা হয়। এই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন ক্লায়স্থেনিস। ক্লায়স্থেনিস যদিও অভিজাত পরিবারের সদস্য ছিলেন, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে জনতার কাতারে যোগ দিয়েছিলেন নাগরিক অধিকার ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে। কিন্তু অভিজাত পরিবারগোষ্ঠী তা মেনে নিতে পারেনি এবং তাদের প্রতিনিধি আইসাগরাস ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এথেন্সের শত্রু শহর স্পার্টার সঙ্গে মিলে। স্পার্টার রাজা ক্লিওমেনেসের সহযোগিতায় আইসাগরাস স্পার্টার সেনাবাহিনী নিয়ে ক্ষমতা দখল করে এবং ক্লায়স্থেনিসকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। ফলে আবারও এথেন্স ও এথেন্সের নাগরিকদের ওপর চেপে বসে স্বৈরাচারী শাসন।
কিন্তু এথেন্সবাসী ভুলতে পারেনি মুক্তির ঘ্রাণ, আর তাই দুই বছর যেতে না যেতেই ৫০৮ খ্রিস্টপূর্বে তারা আবারও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং আবারও গণ-আন্দোলন তৈরি করে। সাধারণ মানুষের তোপের মুখে আইসাগরাস এবং তার সমর্থকরা পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এক্রোপলিসে আশ্রয় নেয়। দুই দিন সেখানে ঘেরাও অবস্থায় থাকার পর আত্মসর্পণ করলে তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সাধারণ জনতার দাবি অনুযায়ী ক্লায়স্থেনিসকে আবারও তারা ফিরিয়ে নিয়ে আসে তাদের নেতা হিসেবে। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা সাধারণ জনগণের হাতে আসার ঘটনা মানব ইতিহাসে এই প্রথম।
এই পরিস্থিতিতে ক্লায়স্থেনিসের পরবর্তী যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত চিরকালের জন্য বদলে দেয় শুধু এথেন্সবাসীরই নয়, সঙ্গে সমগ্র মানবসমাজের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রা। তিনি অনুধাবন করতে চেষ্টা করলেন এথেন্সবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা। বুঝতে পারলেন যে মুক্তিকামী, স্বাধীনচেতা এথেন্সবাসীর স্বপ্ন কোনো দিনও পূরণ করা সম্ভব হবে না পুরনো শাসনব্যবস্থা দ্বারা, তাদের ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব তাদের হাতেই দিতে হবে। তিনি একটি নাগরিক সভার আয়োজন করলেন এক্রোপলিস পাহাড়ের পাশে। সেই সভায় সব মানুষকে আমন্ত্রণ করলেন তাদের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরতে। ব্যবস্থা করলেন ইতিহাসের প্রথম ভোট ও নির্বাচন—‘হ্যাঁ’র জন্য সাদা পাথরের টুকরা আর কালো পাথরের টুকরা ‘না’র জন্য। এভাবেই জন্ম হয় গণতান্ত্রিক নির্বাচন ও পদ্ধতির। এটাই হচ্ছে আমাদের বর্তমান যুগের পার্লামেন্ট, কংগ্রেস বা সিনেটের সূত্রপাত। (বাকি অংশ আগামীকাল)