নিউইয়র্কে ফাহিম হত্যার সর্বোচ্চ সাজা দাবি প্রবাসিদের

নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জুলাই ২০২০, ৩:৩৮ অপরাহ্ণ
ফাহিম হত্যার সর্বোচ্চ সাজা চেয়ে বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রতিবাদ সভা।সদা-প্রানোচ্ছল তরুণ এই বাংলাদেশি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়েছিলো তার মেধার সুবাশ। এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে বিশ্বের লাখো-কোটি তরুণদের অনুপ্ররেণার বাতিঘরও ছিলেন ফাহিম।শৈশব থেকেই উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করে তিনি। যৌবনে পা দেবার আগেই, উন্নয়নশীল দেশসমূহে বিনিয়োগের পথ খুঁজে বের করেন তিনি। সালেহ’র সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোফাইল বলছে, ৩৩ বছরের জীবনে ১৫ বছরই উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করেছেন তরুণ এই বাংলাদেশি।ফাহিম মূলত আলোচনায় আসেন ২০১৮ সালে। বাংলাদেশের রাইড-শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান পাঠাওয়ের কো-ফাউন্ডার ফাহিম ছিলেন দেশের সম্পদ। প্রায় ২ লাখ বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের সুযোগও করে দিয়েছিলেন তিনি। যার চোখে-মুখে ছিল আকাশছোঁয়া স্বপ্ন। সময় পেলে, প্রিয় মাতৃভূমির টানে বারবার ছুটে যেতেন ঢাকায়।
ফাহিমের সফল রাইড-শেয়ারিং উদ্যোগ বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিস্তার লাভ করে বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশের আ্যাপভিত্তিক ‘পাঠাও’ ছাড়াও কলাম্বিয়া, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় ছিল তার একই ধরণের ব্যবসা। পরিকল্পনা মাফিক আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশ নাইজেরিয়াতে নেটওয়ার্ক বিস্তার করেন তিনি। লক্ষ্য বাস্তবায়নে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে গড়ে তুলেন গোকাডা’ নামের অ্যাপনির্ভর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। নাইজেরিয়ায় লাগোসে যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ফাহিমের মোটরবাইক রাইড সার্ভিস-সেবা ছিল দেশটির অসংখ্য তরুণের ‘স্বপ্নসিঁড়ি’।

ফাহিম একাধারে ছিলেন সফল উদ্যোক্তা সেই সঙ্গে তার ছিল অসম্ভব মানবিক গুনাবলি। শৈশব থেকেই ইনোভেটিভ আইডিয়া কাজে লাগিয়ে দ্রুতই পৌঁছে গেছেন মাল্টি মিলিওনিয়ারের কাতারে। তথ্য-প্রযুক্তির সফল গুনাবলিকে কাজে লাগাতে মরিয়া ছিলেন ফাহিম। যা ফুটে উঠে তার ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো সোশ্যাল মিডিয়াতে। অসম্ভব প্রতিভাবান ফাহিম কেবল ব্যবসা নয়; সামাজিক কাজেও সম্পৃক্ত ছিলেন। স্বজনদের প্রতি অঘাত ভালোবাসা ছিল তার।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই তরুণ ছিলেন দেশ ও বিশ্বের এগিয়ে যাওয়া নক্ষত্র। বসবাস করতেন অভিবাসীদের স্বর্গরাজ্য খ্যাত নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটনে। যদিও; জীবিত থাকতে নয়; আমেরিকান কমিউনিটিতে ফাহিম পরিচিতি পায় তার নির্মম মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। মেধাবী এই তরুণকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। হত্যার ভয়াবহতা নিউইর্কের জন্য নজিরবিহীন ঘটনা। গেলো ১৪ জুলাই, মঙ্গলবার বিকেলে ম্যানহাটানের লোয়্যার ইস্ট সাইডের বিলাসবহুল বাড়িতেই হত্যার শিকার হন বাংলাদেশি ফাহিম।অসম্ভব প্রতিভার অধিকারী তরুণ বাংলাদেশির নির্মম হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না কমিউনিটি। কে জানতো বীভৎস ও নারকীয় হত্যাকাণ্ডে স্বপ্নের হিমালয়ের ছুড়ায় উঠা, ফাহিমের মতো টগবগে তরুণ ঝরে যাবে নিমিষে? বিষয়টি কল্পনারও বাহিরে।

বিশ্বজুড়ে লাখো তুরণের স্বপ্নদ্রষ্টা ফাহিম সালেহকে নির্মমভাবে হত্যার প্রতিবাদে মাঠে নেমেছেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশি- আমেরিকান কমিউনিটি। আয়োজক সংগঠন হচ্ছে নিউইয়র্কের ব্রঙ্কসের বাংলাদেশি আমেরিকান কমিউনিটি কাউন্সিল।২১ জুলাই মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ৭টায় ফাহিম যে বহুতল ভবনে হত্যার শিকার হন, তার সামনেই জড়ো হন বিভিন্ন মতপথের বাংলাদেশি-আমেরিকানরা। কমিউনিটির একটি সংগঠনের ব্যানারো প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলেও।
এতে বাংলাদেশি’সহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির অনেকেই অংশ নেন।প্রতিবাদ সমাবেশের শুরুতেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার ফহিম সালেহ’র আত্মার মাগফিরাত চেয়ে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। এতে দোয়া পরিচালনা করেন পার্কচেস্টার জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম।আয়োজক সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ এন মজুদমদারের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক নজরুল হকের সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য রাখেন কর্মসূচিতে একাত্মতা পোষনকারি বিভিন্ন পর্যায়ের কমিউনিটি নেতারা। সমাবেশে উপস্থিত সবার চোখে-মুখে ফুটে উঠে ক্ষোভ আর প্রতিবাদের ছাপ।সবার মুখে ঘুরে ফিরে উঠে আসে ফাহিম হত্যাকাণ্ড এবং এর বিচার প্রক্রিয়া ইস্যু; উঠে খুনির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের দাবি।তবে নিউইয়র্ক রাজ্যে আমৃত্যু কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও, মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান নেই। প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারীদের আহবান প্রয়োজনে স্টেট আইনের পরিবর্তন করতে হবে। আর এ জন্য নিউইয়র্ক সিটি মেয়র থেকে শুরু করে রাজ্য প্রশাসন ও আইনপ্রণেতাদের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা হবে।
এরআগে প্রতিবাদ সভায় ফাহিম সালেহ হত্যাকাণ্ড নিয়ে এভাবেই নিজেদের অবস্থান জানান দেন সংশ্লিষ্টরা।যে ঘৃণ্য এবং জঘন্যভাবে এক তরুণ এবং উদীয়মান সম্ভাবনাকে হত্যা করা হয়েছে তার বিচার প্রক্রিয়া যাতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের হয় এমন দাবিও ছিলো অনেকের। তাদের মতে, ফাহিম সালেহ হত্যা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। ফলে, তাকে নির্মমভাবে হত্যার ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এদিকে, বাংলাদেশের জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ‘পাঠাও’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহকে হত্যার কথা অস্বীকার করেছে অভিযুক্ত টেরেস ডেভোন হ্যাসপিল। এমনকি‘সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডারের’ অভিযোগ নিয়েও আপত্তি তুলেছে সে ও তার আইনজীবী। হ্যাসপিলের ব্যক্তিগত আইনজীবীর বরাত দিয়ে এসব তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে আমেরিকার মূলধারার গণমাধ্যমে।বিষয়টিকে হাল্কাভাবে নিচ্ছে না বাংলাদেশি কমিউনিটি।তাদের মতে, যতক্ষণ পর্যন্ত হত্যাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তির খবর না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ন্যায্য দাবি চালিয়ে যাবে।গেলো ১৪ জুলাই মঙ্গলবার বিকেলে নিউইয়র্ক সিটির লোয়ার ইস্ট ম্যানহাটনের ২৫৬ ইস্ট-হিউস্টনে নিজের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে
কনডোমিনিয়ামেই ভয়ঙ্কর হত্যার শিকার হন বাংলাদেশি ফাহিম।তার টুকরো মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার তিনদিনের মাথায় হত্যাকারীকে গ্রেফতারে সক্ষময় হয় নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ। এখন চলছে বিচার কাজ।পুলিশ বলছে, গেলো সোম ও মঙ্গলবার, দু’দিনই ফাহিমের অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করে হত্যাকারী। ঘটনার পর থেকেই তার সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে মাঠে নামে এনওয়াইপিডির বিশেষ টিম। অবশেষে ১৭ জলাই, শুক্রবার পাষাণ্ড হত্যাকারীকে আটকের পর।আনুষ্ঠানিকভাবে তার পরিচয় প্রকাশ করা হয়।জানা যায় হত্যাকারী ফাহিমের ব্যাক্তিগত সহকারি টাইরিস ডেভন হ্যাসপিল। ২১ বছর বয়সি ওই তরুণ কেনইবা নিজের বসকে হত্যা করলো; এমন প্রশ্নের মুখেও পড়ে মানুষরূপি ওই পাষণ্ড।
প্রতিভাবান টেক এন্টারপ্রেনর ফাহিম সালেহ’র মর্মান্তিক মৃত্যু কতটা ভয়ঙ্কর ছিলো, তা তুলে ধরেন, নিউইয়র্ক পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা।মোটা অঙ্কের ডলার চুরির বিষয়টি ফাহিম জেনে যাওয়ায় তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় ওই ব্যক্তিগত সহকারি। হত্যাকারীর সঙ্গে ফাহিমের খুদে বার্তা’সহ নানা বিষয় খতিয়ে দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।অর্থ চুরি করেও বসের উদারতার সুযোগ নেয় হত্যাকারী পাষাণ্ড টাইরেস। লাখো তরুণের স্বপ্নের অনুপ্রেরণার বাতিঘরকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার মধ্যদিয়ে নিজেকে নর্দমার কিটের চাইতেও নিকৃষ্ট প্রমাণ করলো ব্যক্তিগত সহকারী নামধারী ওই হত্যাকারী।
টাইরিস ডেভন হ্যাসপিলের বিরুদ্ধে শুক্রবারই আদালতে অনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়। প্রাথমিকভাবে তার বিরুদ্ধে সেকেন্ড ডিগ্রি সাজা ঘোষণা করে আদালত।এর প্রতিবাদ জানায় কমিউনিটি।তাদের মতে ফাহিম সালেহ কেবল বাংলাদেশেরই নয় সে আমেরিকার সম্পদ। একই সঙ্গে এ দেশের মর্যাদাবান নাগরিক। ফলে, হত্যাকারীকে গ্রেফতারের পর প্রাথমিকভাবে দেয়া আদালতের রায় সংশোধন চাইছেন বাংলাদেশি আমেরিকানরা।সবশেষ খবরে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যাবতীয় তদন্ত প্রতিবেদন এরইমধ্যে শেষ হয়েছে। ফলে, মুসলিম রীতি অনুসারে ফাহিম সালেহকে শেষ বিদায় জানিয়েছে তার শোকাহত স্বজনরা।
নিউইয়র্ক সিটি থেকে কয়েকশো কিলোমিটার উত্তরে আপস্টেট ডাচেস কাউন্টিতে ফাহিম সালেহর দাফন ও জানাজা ১৯ জুলাই অনুষ্ঠিত হয়।ফাহিমের বাবা মায়ের ইচ্ছেনুসারে আপস্টেট-এর মুসলিম কবরস্থান “মিট হাডসন নুর ইসলামিক সিমেট্রি”তে চিরনিন্দ্রায় শায়িত করা হয় লাখো তরুণদের এই স্বপ্নদ্রষ্টাকে। সংশ্লিষ্টদের মতে- ফাহিমের অকাল মৃত্যুর ক্ষতি কেবল বাংলাদেশেরই হয়নি; বরং থমকে দিয়েছে বিশ্ব তরুণদের অনুপ্ররেণাকেও। তাইতো প্রযুক্তিনির্ভর রাইড-শেয়ারিং ব্যবসার অন্যতম এ কারিগর, আমাদের সবার মাঝে থাকবেন মরেই অমর হয়ে।