ঈদে সংকটে দক্ষিণের মানুষ থাকছে না স্পেশাল সার্ভিস লঞ্চ ও বাস

নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জুলাই ২০২০, ২:৪৭ পূর্বাহ্ণ
চরম দুর্ভোগ শিমুলিয়া-পাটুরিয়া ফেরি পয়েন্টে
স্বস্তির খবর নেই এবারের ঈদযাত্রায়। করোনা মহামারীর মধ্যে জরুরি না হলে যেমন ভ্রমণে ইচ্ছুক নয় সাধারণ মানুষ, তেমনি লাগাতার লোকসানে চোখে অন্ধকার দেখছেন লঞ্চ মালিকরা।যে কারণে এবার ঈদে কোনো স্পেশাল সার্ভিস না চালানোর ঘোষণা দিয়েছে তারা। একই পরিস্থিতি সড়ক ও আকাশপথেও। স্বাভাবিক সময়ে ঈদের ১৫ দিন আগেই শেষ হয়ে যায় লঞ্চ, বাস বা উড়োজাহাজের টিকিট।এবার ভাড়া কমানোসহ নানা আকর্ষণীয় অফার দিয়েও মিলছে না যাত্রী। জটিলতা তৈরি হয়েছে পদ্মা পারাপারের দুই ফেরি পয়েন্ট শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি আর পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায়। সড়কপথে যাতায়াতে এই দুই ফেরি পার হয়েই চলতে হয় বরিশাল ও খুলনা বিভাগের মানুষকে।
বন্যার পানি নামতে থাকায় তীব্র স্রোতের কারণে বন্ধপ্রায় শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ির ফেরি। দুই ঘাটের চাপ সামলাতে গিয়ে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ার ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকি ২-৩ দিন পর্যন্ত আটকে থাকছে যানবাহন। সবকিছু মিলিয়ে এবারের ঈদযাত্রায় পদে পদে কেবল সংকটই দেখছে দক্ষিণ।
পদ্মা পারাপারের দুই ফেরি পয়েন্ট : ক’দিন ধরেই পদ্মা হয়ে সাগরে নামছে উত্তরাঞ্চলের বন্যার পানি। ঢলের তীব্রতা এত বেশি যে কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া ফেরি চলতে পারছে না। ১৬ জুলাই যানবাহন বোঝাই একটি ফেরি স্রোতে ভাসিয়ে নেয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় ফেরি চলাচল। ৩ দিন বন্ধ থাকার পর সীমিত আকারে ফেরি চালু হলেও চাহিদার সিকিভাগও পূরণ হচ্ছে না। কাঁঠালবাড়ি পয়েন্টে বিআইডব্লিউটিসির ব্যবস্থাপক আবদুল আলিম বলেন, ‘এই পয়েন্টে ১৫ ফেরির মধ্যে বর্তমানে চলছে ৬টি। প্রধানত পার করা হচ্ছে মাইক্রোবাস প্রাইভেটকারসহ ছোট গাড়ি। স্রোতের কারণে সময়ও লাগছে বেশি। রাউন্ড ট্রিপ দিতে যেখানে ৩ ঘণ্টা সময় লাগে সেখানে এখন লাগছে ৬ ঘণ্টা। দৈনিক গড়ে ৩ থেকে ৪শ’ গাড়ি পার করছি আমরা। অথচ এই পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন কম করে হলেও দেড় হাজার যানবাহন পার হতো।পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় ১৫টি ফেরির মধ্যে চলছে ১৩টি। বুধবার বিকালে ফেরি পয়েন্টে গিয়ে চোখে পড়ে পারের অপেক্ষায় থাকা যানবাহনের দীর্ঘ সারি।
দৌলতদিয়া পয়েন্টে সাড়ে ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন। একই চিত্র পাটুরিয়া পয়েন্টেও।চট্টগ্রাম থেকে রড নিয়ে বরিশালের উদ্দেশে রওনা হওয়া ট্রাক ড্রাইভার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘৩ দিন ঘাটে বসে আছি। ফেরি পার হওয়ার সুযোগ পাচ্ছি না।’ পাটুরিয়ায় বিআইডব্লিউটিসির ব্যবস্থাপক আবদুস সালাম বলেন, ‘স্রোতের কারণে নদী পার হতে দেড়গুণ বেশি সময় লাগছে।ফলে কমে গেছে ট্রিপের সংখ্যা। আগে যেখানে দৈনিক গড়ে ২শ’ ট্রিপ দিতাম সেখানে এখন দেড়শই দেয়া যাচ্ছে না। তার ওপর ঘাটে আসছে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি পয়েন্টের বাড়তি গাড়ি।’ তিনি বলেন, যাত্রীবাহী যানবাহন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার করা হচ্ছে। পাটুরিয়ায় এখন ৩-৪শ’ ট্রাক অপেক্ষমাণ থাকতে পারে। বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে টিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, ‘স্রোতের তীব্রতা না কমা পর্যন্ত এ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
নৌ-পথে যাত্রীশূন্যতা করোনার কারণে টানা ৬২ দিন বন্ধ থাকার পর ৩১ মে থেকে শুরু হয় রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের লঞ্চ চলাচল।
প্রথম ক’দিন ভালো যাত্রী হলেও এরপর কমতে শুরু করে। একপর্যায়ে যাত্রী সংকটে বন্ধ হয়ে যায় অনেক লঞ্চ। লোকসান দিয়ে কিছু লঞ্চ চললেও যাত্রীর সংখ্যা বাড়েনি। ঈদেও একই পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন লঞ্চ মালিকরা। ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী সুন্দরবন নেভিগেশনের পরিচালক আকতার হোসেন আকেজ বলেন, ‘আগে এ সময়ে যাত্রীদের চাপে মোবাইল বন্ধ করে বসে থাকতে হতো। কিন্তু এবার ঈদে অগ্রিম টিকিটও দিচ্ছি না আমরা। যাত্রীরা কাউন্টারে গিয়েই পাচ্ছে টিকিট। তারপরও এখন পর্যন্ত ঈদের শতকরা ২০ ভাগ টিকিটও বিক্রি হয়নি।কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘ঢাকা-বরিশাল রুটে ডে-নাইট সার্ভিস মিলিয়ে ২৩টি লঞ্চ চলাচল করে। ঈদে যাত্রীদের যে চাপ লক্ষ্য করছি তাতে এই ২৩টি লঞ্চেরই দরকার হবে কিনা সন্দেহ। তাই এ বছর স্পেশাল সার্ভিস পরিচালনার কোনো চিন্তাভাবনা নেই।’ অ্যাডভেঞ্চার লঞ্চের মালিক নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘সার্ভিস চালু রাখতে গিয়ে প্রতি রাউন্ড ট্রিপে গড়ে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা লোকসান দিচ্ছি।
এবার ঈদেও যদি যাত্রী না হয় তাহলে লঞ্চ চলাচলই বন্ধ করে দিতে হবে।সংকট সড়ক আর আকাশপথে ও ঢাকা-বরিশাল রুটে বর্তমানে প্রতিদিন দুটি করে ফ্লাইট চালাচ্ছে ইউএস বাংলা ও নভোএয়ার। শনিবার থেকে একটি করে ফ্লাইট পরিচালনা করার কথা রয়েছে বাংলাদেশ বিমানের। বেসরকারি সংস্থাগুলোর প্রতি ফ্লাইটে গড়ে ২শ’ যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে তারা নিতে পারবে ১শ’। অথচ বর্তমানে কোনো ফ্লাইটেই ২৫-৩০ জনের বেশি যাত্রী হচ্ছে না। বরিশালের টিকিটিং এজেন্ট দেশ ট্রাভেলসের মালিক ফিরোজ মোস্তফা জানান, ‘একবারের জার্নিতে ২৫শ’ টাকা ভাড়া নির্ধারণের পর শতকরা ১২ ভাগ ডিসকাউন্ট দিয়েও মিলছে না যাত্রী। আসন্ন ঈদের অগ্রিম বুকিং প্রশ্নেও একই পরিস্থিতি। আগে যেখানে এ সময়ে টিকিটের মূল্য ৭-৮ হাজার টাকা হওয়ার পরও রিটার্নসহ সব টিকিট বিক্রি হয়ে যেত সেখানে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মাত্র ১টি টিকিট বিক্রি হয়েছে আমাদের।সড়কপথে সংকটের কথা জানিয়েছেন ঢাকা-বরিশাল রুটে বাস পরিচালনায় নিয়োজিত কর্মীরা।
সাকুরা পরিবহনের বরিশাল কাউন্টারে কর্মরত আনিসুর রহমান বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনেও করোনার ভয়ে মিলছে না যাত্রী। প্রতিবার ঈদে স্পেশাল সার্ভিস থাকে আমাদের। যাত্রী সংকটে এবার তা থাকছে না। নিয়মিত সার্ভিসের গাড়িগুলোই চালাতে হচ্ছে লোকসান দিয়ে। আজ (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত ঈদযাত্রার শতকরা ৪০ ভাগ টিকিটও বিক্রি হয়নি।’ প্রায় একই কথা বলেন গ্রিনলাইনসহ অন্যান্য পরিবহনের প্রতিনিধিরা।বরিশাল নাগরিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘খুব জরুরি না হলে করোনা পরিস্থিতিতে গণপরিবহন এড়িয়ে চলাই ভালো।
তারপরও পদ্মা পারাপারের দুই ফেরি পয়েন্টে যে অচলাবস্থা চলছে তাতে পণ্য পরিবহনসহ নানা ক্ষেত্রে সংকটে পড়বে দক্ষিণাঞ্চল।তাছাড়া লঞ্চ, বাস ও উড়োজাহাজে যে জটিলতা, এসব ব্যাপারে সরকারের উচিত ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া। লোকসানের কারণে সত্যি সত্যি যদি মালিকরা লঞ্চ চালানো বন্ধ করে দেয় তাহলে এই অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না।