মুগ্ধতা ছড়িয়েছে বলাকইড় বিল

নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২:৫৪ অপরাহ্ণ
জলজ ফুলের রানী বলা হয় পদ্মকে। ফুটে থাকা ফুল শুধু বিল নয়, সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে প্রকৃতির। আর এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেখা মিলছে গোপালগঞ্জের বলাকইড় বিলে। দূর থেকে মনে হবে যেন ফুলের বিছানা পেতে রেখেছে কেউ। তবে এ বছর বিলে পদ্ম কিছুটা কম ফুটেছে। আর এজন্য বিগত বছরগুলোতে পদ্মফুল ছেড়াকেই দায়ী করেছেন স্থানীয়রা।
তারপরেও প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া পদ্মফুল সৌন্দর্য আকৃষ্ট করায় এ বিলে প্রতিনিয়ত ভিড় করেছে দর্শনার্থীরা। শুধু সৌন্দর্যই নয়, বর্ষাকালে কোনো কাজ না থাকায় বিলে দর্শনার্থীদের ঘুরিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন স্থানীয়রা।
সদর উপজেলার করপাড়া ইউনিয়নের বলাকইড় বিলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ভোরের সূর্যের সোনালী আভার সাথে প্রকৃতি যেন তার সবটুকু সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে বলাকইড় পদ্মবিলে। চোখের দৃষ্টি যতদূর যাবে ততদূরেই দেখা মিলবে গোলাপি আর সাদা পদ্মের। বিস্তীর্ণ বিলজুড়ে পদ্মের সমাহার।
আর প্রকৃতির এমন সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে যেতে হবে গোপালগঞ্জ জেলা শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিলবেষ্টিত বলাকইড় গ্রামে। ১৯৮৮ সালের পর থেকে বর্ষাকালে এ বিলে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয় পদ্মফুল। আর যে কারণে এখন এ বিলটি পদ্মবিল নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছে সবার কাছে।
বর্ষা মৌসুমে এ বিলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ফুটে থাকে গোলাপি ও সাদা রঙের পদ্ম, যা দেখলে মনপ্রাণ আর চোখ জুড়িয়ে যায়। ৬৪টি পাপড়ি মেলে প্রকৃতিপ্রেমীদের স্বাগত জানায় জলজ ফুলের রানী পদ্ম। এমন অপরূপ দৃশ্য যেন ভ্রমণপিপাসুদের প্রতিনিয়ত হাতছানি দিচ্ছে।
আকাশে সূর্য উঁকি দেয়ার সাথে সাথেই বিলে আসেন পর্যটকরা। পদ্মফুল আর প্রাকৃতিক সৌন্দয্য উপভোগ করার জন্য প্রতিদিনই ছেলে-মেয়ে, পরিবার-পরিজন আর বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ভিড় করছেন দূর-দূরান্ত থেকে আসা প্রকৃতিপ্রেমীরা। বিলের মধ্যে নৌকায় ঘুরে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পদ্মফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করেন তারা। অনেকেই আবার এমন অপরূপ সৌন্দয্য ক্যামেরার ফ্রেমেবন্দি করে রাখছেন তারা। স্থানীয়রাও ভ্রমণপিপাসুদের সার্বিক সহযোগিতা করছেন।
এদিকে বর্ষা মৌসুমে এ বিলে প্রায় ১০ হাত পানি থাকে। সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের এ সময় কোন কাজ থাকে না। বর্ষা মৌসুমে কোন কাজ না থাকায় দর্শনার্থীদের নৌকায় ঘুরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন দুই শতাধিক পরিবার। ছোট বড় প্রায় দুই শতাধিক নৌকা দিয়ে দর্শনার্থীদের পদ্মবিলের সৌন্দয্য ঘুরিয়ে দেখান তারা। দৈনিক ৮শ’ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন তারা। এতে তাদের পরিবারের এসেছে স্বাচ্ছন্দ্য।
এছাড়া সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজায় পদ্মফুলের চাহিদা থাকায় ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত বিল থেকে পদ্মফুল তুলে বাজারে বিক্রি করছেন অনেকেই। বিল এলাকায় মূল্য কম থাকলেও শহরে এক একটি ফুল ৫ থেকে ১০ টাকায় বিক্রি করছেন। মোটরসাইকেলের টোকেন দিয়েও আয় করছেন অনেকে। বাড়ির উঠোনে দর্শনার্থীদের মোটরসাইকেল রেখে দৈনিক ৩শ’ থেকে ৫শ’ হাজার টাকা আয় করছেন।
তবে পদ্মবিলে আসার একমাত্র সড়কটি অপ্রস্থ ও বেহাল অবস্থায় হওয়ায় আসা যাওয়ায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে দর্শনার্থীদের। দ্রুত সড়কটি মেরামতের দাবি জানিয়েছেন তারা।
পদ্মবিলের সৌন্দয্য উপভোগ করতে আসা গোপালগঞ্জ জেলা শহরের নিউটন মোল্যা ও সাইফুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন ধরে ঘরবন্দি অবস্থায় রয়েছি। একুট প্রশান্তির জন্য বলাকইড় পদ্মবিলে এসেছি। এ বিলের সৌন্দয্য দেখে বিমহিত হয়েছি। এখানে ঘুরতে আসলেই যেন মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু এ বছর পদ্ম একটু কম। পদ্ম ছেড়ার কারণে এ বছর ফুলও একটু কম ফুটেছে।
খুলনা থেকে ঘুরতে আসা শুভজিত সাহা বলেন, বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও ইউটিউবে গোপালগঞ্জের পদ্মবিলের কথা শুনেছি। এ বছর ছুটি থাকায় তাই এখানে পদ্মবিল দেখতে এসেছি। এখানে আসলেই প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য কাছ থেকে দেখা যায়।
মাঝি আরিফুল ইসলাম ও সুমন চৌধুরী জানান, বর্ষার সময় বিলের জমি পানিতে তলিয়ে থাকায় বছরে মাত্র একটি ফসল ফলে। যে কারণে বছরের অর্ধেকটা কাজ থাকে না। আর এ সময় দর্শনার্থীরা পদ্মবিল দেখতে ও ঘুরতে আসেন। সপ্তাহের প্রতি শুক্র-শনিবার দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশি থাকে। এ দুইদিন দর্শনার্থীদের নৌকায় ঘুরিয়ে আমাদের আয়-রোজগার হয়। এখানে ছোট সাইজের নৌকা ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা ও বড় সাইজের নৌকা ৮শ’ থেকে এক হাজার টাকায় ভাড়া হয়। বছরের ৩ থেকে ৪ মাস দর্শনার্থীদের নৌকায় ঘুরিয়ে আয় করে সংসার চালান তিনি।
বলাকইড় গ্রামের তাজমুল চৌধুরী বলেন, তার ১০ সদস্যের পরিবার। শ্রমিক বাবার রোজগার দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। তাই সে পদ্মবিল দেখতে আসা দর্শনার্থীদের নৌকায় ঘুরিয়ে থাকেন। এতে তার দৈনিক ৮শ’ থেকে এক হাজার টাকা আয় হয়। এতে তাদের সংসার খুব ভালোভাবেই চলে যাচ্ছে।
বিলপাড়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র তামিম সরদার বলেন, তাদের কোরবানি ঈদের আগে ও পরে দর্শনার্থীদের অনেক চাপ ছিলো। তখন প্রতিদিন এক-দেড়শ’ মোটরসাইকেল রেখেছেন। প্রতি মোটরসাইকেল থেকে সে ২০ টাকা করে নেয়। এই টাকা দিয়ে সে লেখাপড়া করার পাশাপাশি পরিবারের জন্য খরচ করে।
গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা জানিয়েছেন, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় রয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি। এছাড়া কোটালীপাড়ায় রয়েছে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচায্যের পৌত্রিক ভিটা। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা এখানে আসনে। সেখানে থেকে তারা পদ্মফুলের সৌন্দয্য উপভোগ করতে বলাকইড় পদ্মবিলে যান। পদ্মমৌসুমকে কেন্দ্র করে এখানে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা যায় কিনা, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে জানাতো হয়েছে।