বাংলাদেশে নারীরা কেন সাংবাদিকতায় কম আসেন ?

নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ জুলাই ২০২২, ৯:৩৭ অপরাহ্ণ
২০১৫ সাল। ভোর ৬টা। খবর আসে মালিতে জাতিসংঘ মিশনে থাকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য নীলকণ্ঠ হাজং বিদ্রোহীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। তার গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের দুর্গম অঞ্চলে। এই আদিবাসী সৈন্যের মৃত্যুর খবর শুনে তড়িঘড়ি করে নেত্রকোনার বাসা থেকে বের হন সাংবাদিক আলপনা বেগম। সঙ্গী তার মোটরবাইক। এই যাত্রা কোনো সাধারণ যাত্রা নয়। নেত্রকোনা সীমান্ত দিয়ে সুনামগঞ্জের দিকে ভয়াবহ কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে। এ সময় মহেশখোলা নদী ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়াও অন্যান্য আরও নদী ছিল। গাছের শিকড়-বাকড় ধরে হেঁটে যাওয়ার পথ। তবে মোটরবাইক নিয়ে যাওয়ায় কিছু অসুবিধাও হয়। সেখানে ছিল অসংখ্য খাল বা ছড়া। বিজিবি সদস্যরা এগুলো হেঁটে পাড়ি দেন। আলপনার কাছে মোটরবাইক থাকায় একটু বিপাকে পড়তে হয়।
বলতে বলতে হেসে ফেলেন আলপনা বেগম। বলেন, এই যাত্রার কথা মাথা থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। মহেশখোলা নদীর কাছেই মোটরবাইক নিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। পরে বিভিন্ন বিওপির সাহায্য নিয়ে আমি নীলকণ্ঠ হাজংয়ের বাড়িতে বিকেল ৪টার দিকে পৌঁছতে সক্ষম হই। সেখানে আমাদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহত সৈন্যের স্বজনরা। সেখান থেকে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে এবং বক্তব্য ধারণ করে রিপোর্ট তৈরি করে সন্ধ্যার পর রওনা দিই। ফেরার পথে নামে ঝুম বৃষ্টি ও বজ্রপাত। ফলে পাহাড়ি পথ আরও পিচ্ছিল হয়। ধর্মপাশা মধ্যনগর নৌকায় পার হই। পরে সুনামগঞ্জ হাওড়ের মাঝ দিয়ে অন্তত তিনটি বড় নদী পাড়ি দিয়ে ১০টার দিকে বাড়ি ফিরি। তিনি বলেন, জায়গাটি এতই নিঝুম ছিল যে প্রায় ১৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না।
আলপনা বেগম একজন মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিক। নেত্রকোনার আনাচে-কানাচে মোটরবাইক চালিয়ে তিনি ২২ বছর ধরে নিত্য ছুটছেন নতুন খবরের খোঁজে। তার একটি মোটরবাইক রয়েছে। এই যন্ত্রটিও তার পোষ মানা। প্রায় চৌদ্দ বছর ধরে এটি তার পথচলার সঙ্গী।
চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসেবে সাংবাদিকতার কদর রয়েছে। এই পেশার অনিশ্চয়তার নিশ্চয়তায় মজে ঐতিহাসিকভাবেই নারী-পুরুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হন। পুরুষদের এই পেশায় বেশি আসতে দেখা গেলেও অনেক স্থানে নারীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম দেখা যায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নারী সাংবাদিকতা অনেকটুকু এগোলেও প্রতিবন্ধকতা আর ভ্রান্ত মূল্যবোধের জাঁতাকলে পড়ে এখনো কিছুটা ছোপ ছোপ অন্ধকার রয়ে গেছে এই পেশার প্রসারের পথে।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬২ সালে সাংবাদিকতা বিভাগ চালু হয়। শুরুতে এটি ডিপ্লোমা কোর্সের অন্তর্গত ছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগ চালু হয় ১৯৯৩ সালে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৪-৯৫ সালে। সাংবাদিকতার প্রচার ও প্রসার বাড়াতে ২০১১ সালে যাত্রা শুরু করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ প্রভৃতিতে সাংবাদিকতা কোর্স চালু রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যয়ন শেষে শিক্ষার্থীরা শুধু সাংবাদিকতা করছে তা নয়চ বরং গণসংযোগ, বিজ্ঞাপন এজেন্সি, ফিল্ম মেকিং, ব্যাংকিং ও শিক্ষকতার মতো বিভিন্ন পেশায় ক্যারিয়ার গড়ারও সুযোগ পাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকদের সংখ্যা খুব একটা বাড়েনি। জাতীয় প্রেসক্লাবের ২ হাজার ১৮ জন সাংবাদিকের মধ্যে নারী সাংবাদিকের সংখ্যা মাত্র ৭২ জন। এ ছাড়া ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রায় ছয় হাজার সদস্যের মধ্যে নারী সাংবাদিকের সংখ্যা ১৫০ জনের বেশি নয়। এখনো অনেক বাধাবিপত্তি রয়ে যাওয়ার কারণেই এমনটা হয়েছে।
গ্লোবাল মিডিয়া মনিটরিং প্রজেক্টের এক হিসাব অনুযায়ী, সংবাদপত্রে ৮ শতাংশ, রেডিওতে ৩৩ শতাংশ এবং টেলিভিশনে ১৯ শতাংশ নারী সাংবাদিক কাজ করেন। তবে নারীদের দেখা মেলে উপস্থাপনায়। রেডিও বা টেলিভিশনের ৬০ শতাংশেরও বেশি উপস্থাপক নারী। তবে এখনো নারীদের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনীতিবিষয়ক রিপোর্টে কম দেখা যায়। বিষয়টি কি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারার জন্য, নাকি লৈঙ্গিক রাজনীতিতে দুর্বলতার জন্য ঘটছে, তা বোঝা দুষ্কর।
এ বিষয়ে কথা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নিশাত পারভেজের সঙ্গে। নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তি ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তার ওপর জোর দেন তিনি। নিশাত বলেন, ‘প্রথমেই আমাদের ভাবতে হবে মেয়েদের জন্য অর্থনৈতিক মুক্তির জায়গা আছে কি না। দ্বিতীয়ত, আমাদের মাথায় রাখতে হবে মেয়েদের জন্য চাকরির জন্য নিরাপদ পরিবেশ আছে কি না। আমরা সাংবাদিকতাকে এখন পর্যন্ত একটা পুরুষশাসিত জগৎ হিসেবে দেখি। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে অনেকে পাস করছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতাও করছে তারা। তবে সাংবাদিকতায় নারীদের কমই দেখা যাচ্ছে। তবে আপনি যদি দেখেন, সাংবাদিকতায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ নেই। আরও কিছু বিষয় আছে। যেমন, মাঝে একবার হ্যাশট্যাগ মি-টু আন্দোলন শুরু হয়। তখন আমরা দেখেছি কী অবস্থা দাঁড়িয়েছিল।’
নিশাত সময় সংবাদকে আরও বলেন, কোনো একটা সাংবাদিকতা হাউজে শীর্ষস্থানে নারীদের কম দেখা যায়। একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত নারীদের পদাধিকার দেয়া হয়। উচ্চপর্যায়ে তারা যেতে পারে না। কর্তৃপক্ষ আর আগ্রহ দেখাতে চায় না। যদি-বা কেউ যায়ও, তাদের নিয়েও কথা হয়, এটাই সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন, মাতৃত্বকালীন ছুটির পর অফিসে কর্মপ্রক্রিয়ায় ফেরার পর অনেক সময় দেখা যায় যিনি রিপোর্টার ছিলেন তিনি নিউজরুম এডিটর হয়ে গেছেন। কর্মপরিবেশের ঘাটতি রয়েছে বলেই এমনটা হচ্ছে। মেয়েদের টাকা কম দরকার হয় ছেলেদের তুলনায়, এমন ধারণাও প্রচলিত রয়েছে।
কী করলে বর্তমান পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব౼এই প্রশ্নের উত্তরে এই শিক্ষক বলেন, এখানে পুরুষদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। কর্মপরিবেশ তৈরি করতে হবে। তবে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল বা দেশের সার্বিক অবস্থার কারণেও কর্মপরিবেশের মানের হেরফের হয়। তাই একদিনে এমন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সাংবাদিকদের বেতন-ভাতার বিষয়টিতেও বিভিন্ন মিডিয়া হাউজগুলোকে আরও মনোযোগী হতে হবে। স্নাতক পাস করে এসেও অনেক নারী-পুরুষ খুবই সামান্য বেতন পান, যা তাদের এই পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে নিরুৎসাহিত করে।
ডিপ্লোমেটিক করেসপনডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও উইমেন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (ডব্লিউজেএনবি)-এর সমন্বয়কারী সাধারণ সম্পাদক আঙ্গুর নাহার মন্টি সময় সংবাদের সঙ্গে তার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নেন। তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে বলতে গেলে বাংলাদেশে আমরা অনেকদূর এগিয়েছি। অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে, যেখানে নারীরা এগিয়ে রয়েছেন। আমরা বৈশ্বিকভাবেও এর জন্য গর্ববোধ করি। তবে এটাও সত্যি, এখনো নারী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নারীরা খুব একটা এগোয়নি। নারীকে মিডিয়ায় কখনো ‘ভিকটিম’ কখনো ‘পণ্য’ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। নারীরা অসাধারণ কাজও করছে। কিন্তু সে অনুযায়ী তারা ফল পাচ্ছে না।
জাতীয় প্রেসক্লাবের একজন নারী সভাপতি পেতেও আমাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। এ ছাড়া ধরুন, যারা এ পেশায় আসে, তারা এই পেশার ঝুঁকি জেনেই আসে। নারী-পুরুষ সবারই এই চ্যালেঞ্জ বা ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয়। তবে নারীর জন্য বিষয়টা আরও কঠিন। তা ছাড়া বেতন-ভাতাও কম। আমরা এত এত নীতিকথা বলি, তবুও এখনো আমাদের কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও অন্যান্য বৈষম্য রয়ে গেছে। অনেক সূক্ষ্ম বৈষম্যের শিকার হন নারীরা। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটা এখনো কম।
তবে আশা ছাড়েননি এই সাংবাদিক। তিনি বলেন, আমাদের অনেক প্রাপ্তিও রয়েছে। আর উপস্থাপনায় বেশি নারী কাজ করছে౼এ বিষয়টাকে আমি ভালোভাবেই দেখছি। কারণ, এতেও সাংবাদিকতার জ্ঞানও প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে, কর্মক্ষেত্রে নারীদের করুণার দরকার নেই। প্রয়োজন নেই কোনো বাড়তি সুবিধার। নারীদের তাদের প্রাপ্য অধিকার বোঝাতে হবে।
প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হচ্ছিল নেত্রকোনার সাংবাদিক আলপনা বেগমের কথা। তিনিও নিশাত পারভেজ ও আঙ্গুর নাহার মন্টির মতোই মনে করেন সীমিত সুযোগ-সুবিধার কারণে এখনো পিছিয়ে রয়েছেন সংবাদমাধ্যমে কাজ করতে আসা নারীরা। তিনিও নারী হওয়ার কারণে বাড়তি অসুবিধার কথা তুলে ধরেন। তবে নারীদের এগিয়ে আসার ব্যাপারে আরও দৃঢ় প্রত্যয়ী হওয়ার কথাও বলেন তিনি।