অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন,প্রতিহিংসাপরায়ণ ও বিব্রতকর : লিটন

নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ এপ্রিল ২০২৩, ৪:৩০ অপরাহ্ণ
নিজের উপরে উত্থাপিত অভিযোগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টির পর এবার নিজেই মুখ খোললেন অভিযুক্ত আমিনুল ইসলাম লিটন। আত্মপক্ষ সমর্থন করে তিনি ব্যক্তিগত টাইমলাইনে রবিবার বিকাল ৩ টা ৫৭ মিনিটে একটি লেখা পোস্ট করেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত ঘটনাকে রটনা উল্লেখ করে ‘মিথ্যা অভিযোগ ও কুৎসার বিরুদ্ধে আমার বক্তব্য’ শিরোনামে একটি বিবৃতি দেন।
বাংলা নিউজ এনওয়াইয়ে আমিনুল লিটনের সেই বক্তব্য হুবুহু প্রকাশ করা হলো-
আমি আমিনুল ইসলাম চৌধুরী লিটন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কথাকলি সিলেটের একজন সদস্য। গত চার দশক ধরে আমি নাটক ও আবৃত্তির পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত।
সম্প্রতি আমি লক্ষ করেছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার নামে সীমাহীন মনগড়া কুৎসা ছড়ানো হচ্ছে, পত্রপত্রিকায়ও লেখালেখি হচ্ছে, অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠনও আমাকে অভিযুক্ত করে বিবৃতি দিচ্ছে। অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন, আমার প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ ও সবার জন্য বিব্রতকর।
ঘটনার সূত্রপাত কথাকলির সদস্য Syeda Fairuj Jarin Subah’র একটা ফেসবুক পোস্ট থেকে। গত মার্চে কথাকলির নাট্য উৎসব চলাকালে আমি দলের একাধিক সদস্য ও উৎসবের অতিথিদের সামনে তার মোটা হয়ে যাওয়া নিয়ে খুবই হালকা মেজাজের একটা মন্তব্য করেছিলাম। সেই মন্তব্যটাকে ওই সময় উপস্থিত কেউই খুব গুরুতর কিছু মনে করেননি, বা কোনো আপত্তিও তোলেননি। আর আমিও খেয়াল করিনি যে কথাটায় সুবা অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছে।
আমি স্বীকার করি, আজকের যুগের নৈতিকতার মানদণ্ডে কারো মোটা হয়ে যাওয়া নিয়ে মন্তব্য করা ‘বডিশেমিং’ হিসেবে গণ্য। সেই হিসেবে তাকে ওই মন্তব্য করাটা উচিত হয়নি। কিন্তু আমরা বড়ো হয়েছি একটা মফস্বল শহরে, যেখানে ছোটবেলা থেকেই চিকন, মোটা, লম্বা, খাটো, কালো, সাদা এগুলো নিয়ে নিজেরা যেমন বন্ধুবান্ধবদের মন্তব্য শুনেছি, তেমনি স্বীকার করতে আপত্তি নেই যে, ওরকম মন্তব্য নিজেরাও করেছি। বর্তমানে এসব চর্চা নিরুৎসাহিত করা হলেও বলতে দ্বিধা নেই যে পুরোনো অভ্যাসে এমন মন্তব্য এখনো আমাদের মুখ থেকে বের হয়ে আসে, যা উচিত নয়।
সুবার ওজন বেড়ে যাওয়া নিয়ে এমন মন্তব্যের জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত। মজা করতে গিয়ে একেবারে অজান্তে, অনিচ্ছায় তাকে মানসিকভাবে কষ্ট দেবার আমি খুবই লজ্জিত।
আমার কথায় কষ্ট পেয়ে সুবা আমার একটা ব্যঙ্গচিত্র এঁকে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিল। সেই পোস্টে আমার কথায় তার রাগের প্রকাশ যেমন ছিল তেমনি আমার সম্পর্কে তার শোনা কথাও যুক্ত ছিল। পাশাপাশি, আমার দাড়ি, যেটা আমার ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় স্বাধীনতার অংশ, সেটা নিয়েও কটাক্ষ ছিল।
কিন্তু তা নিয়ে আমি কোনো প্রতিবাদ বা আপত্তি তোলার কথা চিন্তা করিনি। আমি ভেবেছি, আমার একটা কথায় একজন কষ্ট পেয়েছে, সে তার ক্ষোভের প্রকাশ করেছে, ঠিক আছে, এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়।
কিন্তু এর পরে ওই পোস্টটাকে কেন্দ্র করেই অনেকে আমার নামে ইচ্ছামতো কুৎসা ছড়াতে শুরু করলেন। নারী নিপীড়নের মতো ভয়াবহ অভিযোগ করতে থাকলেন আমার নামে। তখন অনেকেই আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যারা কুৎসা ছড়াচ্ছেন তাদের নামে মানহানি বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করতে। কিন্তু আমি রাজি হইনি, কারণ এমন অভিযোগের সূত্রপাত দলের একজন সদস্যের হাত ধরে। মামলা করলে তার নামেও মামলা করতে হয়। আমার চার দশকের নাট্য চর্চায় আমি কোনোদিনও দলের কারো বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করতে হবে ভাবতে পারিনি।
দলের ভেতরে আমাদের একে অন্যের সাথে দ্বিমত হয়, ভুল বোঝাবুঝি হয়, ঝগড়াও হয়। তারপর সেগুলো হয় নিজেরাই সমাধান করে নেই, আর না পারলে সাংগঠনিকভাবে দলই সমাধানের উদ্যোগ নেয়। এটিই আমি দেখে আসছি গত চল্লিশ বছর ধরে। আমি এর বাইরে যেতে চাইনি। তাই আমি চুপ করে ছিলাম। ভেবেছিলাম বিষয়টা আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে আসবে। কিন্তু দেখলাম আমার নামে অভিযোগের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন অনেকেই। যার সর্বশেষ সংযোজন হলো আমার কণ্ঠ নকল করে তৈরি করা দুটো ফেইক অডিও ক্লিপ।
আমি আবৃত্তি করি, উপস্থাপনা করি, সংবাদ পড়ি, আমার ভয়েজ স্যাম্পল সংগ্রহ করা খুবই সহজ। আর কেউ একজন সেই কাজটাই করেছেন। আমার ভয়েজ নকল করে এক নারী ও পুরুষের টেলিফোন কথোপকথনে পুরুষ কণ্ঠটিকে আমার কণ্ঠ বলে প্রচার করছেন, যা কোনোভাবেই আমার কণ্ঠ নয়। ওই ক্লিপের নারী কণ্ঠের মানুষও আমার পরিচিত নয়। কারো সাথে আমার এরকম কোনো আলোচনা হয়েছিল বলেও মনে করতে পারি না আমি।
আজকের ‘ডিপ ফেইক’ প্রযুক্তির যুগে অডিও, ভিডিও, কিংবা ফেসবুকের স্ক্রিনশট নকল করা খুবই মামুলি বিষয়। এর পরে হয়তো দেখা যাবে কেউ আমার একটা নকল ভিডিও কিংবা নকল ইমেইল অথবা নকল ফেসবুক চ্যাটের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে অপপ্রচারে নেমেছেন।
দীর্ঘ চল্লিশ বছরের সংস্কৃতি চর্চায় ও সাংগঠনিক কার্যক্রমের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেকেই আমার ওপর মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন। অনেক সময়ই সংগঠনের স্বার্থে নিজের ব্যক্তিগত বন্ধু এমনকি কথাকলির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের বিরুদ্ধেও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সেইসব কারণে আমার ওপর তাদের ব্যক্তিগত ক্ষোভ আছে আমি জানি। এবং স্বাভাবিকভাবেই আমি দেখলাম আমার নামে অপপ্রচার ছড়ানোর ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে ও নেপথ্যে তাদের অনেকেই খুব জোরেশোরে নেমেছেন। এতে আমি অবাক হইনি, কারণ আমি অপদস্থ হলে তারা খুশি হবেন, হাততালি দেবেন, তা আমি জানি, আরো অনেকেই জানেন।
সাংগঠনিক কারণেই সিলেটের অন্যান্য নাট্য সংগঠন, সম্মিলিত নাট্য পরিষদ বা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের অনেক সদস্যের সাথেই আমার বিভিন্ন সময় দ্বিমত, ভিন্নমত কিংবা তর্ক বিতর্ক হয়েছে, তাদেরও অনেকে আমার ওপর ক্ষ্যাপা। আমাকে ছোট দেখাতে পারলে কিংবা আমাকে দোষী হিসেব সাব্যস্ত করতে পারলে তাদের অনেকেই শান্তি কিংবা সাংগঠনিক সুবিধা পাবেন আমি জানি। ফলে তাদেরও কেউ কেউ যখন আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে যুক্ত হলেন, আমি অবাক হইনি। কারণ, আমার ওপর যাদের ক্ষোভ আছে, সুযোগ পেলে তারা আমাকে চেপে ধরতে চাইবেন, এ তো স্বাভাবিক।
অভিযোগ যদি শুধু আমার নামে থাকত তাহলে আমি একা চুপ করে থাকতে পারতাম। কিন্তু অভিযোগকারীরা আমাকে কেন্দ্র করে আমার দল কথাকলি, সিলেটের অন্যান্য নাট্যসংগঠন, সম্মিলিত নাট্য পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ যতটা সেক্টরে আমার সম্পৃক্ততা আছে, সবগুলা সেক্টরের সদস্য ও নেতৃবৃন্দকে অতিষ্ঠ করে তুলতে লাগলেন, তাদেরকেও অভিযুক্ত করা শুরু করলেন আমাকে তথাকথিত প্রশ্রয় বা সমর্থন দেবার অভিযোগে।
এখানে সবার অবগতির জন্য একটা বিষয় পরিষ্কার করে জানাতে চাই যে, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কারো নামে অভিযোগ করলেই তাকে দোষী হিসেবে গণ্য করা যায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত না আদালতে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সর্বক্ষেত্র তাকে নির্দোষ হিসেব গণ্য করতে বাধ্য।
আমার বিরুদ্ধে আদালতে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া তো দূরের কথা, আমার নামে আজ পর্যন্ত এসব অভিযোগে কোনো মামলাও দায়ের করেনি কেউ। আমি নির্দোষ।
কথাকলি, অন্যান্য সংগঠন বা ফোরামকে আমার জন্য অভিযোগ করারও সুযোগ নেই। কারণ সোশাল মিডিয়ায় যে অভিযোগগুলো প্রচার হচ্ছে, সেগুলো ফৌজদারি অভিযোগ। কথাকলি, সম্মিলিত নাট্য পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট কিংবা অন্য কোনো সংগঠনের ফৌজদারি অভিযোগ তদন্ত বা বিচার করার এখতিয়ার নেই। যার কারণে সব সংগঠনই প্রথম দিকে নিশ্চুপ হয়ে বসেছিল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেকেই পরিস্থিতির চাপ সহ্য করতে না পেরে নিজেদের দায়মুক্তির জন্য সাংগঠনিকভাবে আমার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে। তাদের কাউকে দোষ দেই না আমি, কারণ যেহেতু তাদেরকেও দোষারোপ করা হচ্ছে, এমন অবস্থায় স্বাভাবিক সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানোও তাদের জন্য বিব্রতকর হয়ে উঠেছে।
সবচে বেশি বিব্রত হয়েছে আমার সংগঠন কথাকলি এবং কথাকলির সকল সদস্য। সকলেই প্রতিদিন অসংখ্য গালাগালি ও অভিযোগের শিকার হচ্ছে, অথচ যাদেরকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, তাদের অনেকেই হয়তো বিষয়টা সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখে না।
এই অবস্থায় আমার মনে হয়েছে সর্বপ্রথম আমার নিজের দল কথাকলিকে এবং সদস্যদের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে রেহাই দেয়া দরকার, সেজন্যই আমি দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে বিরতি নেবার কথা দলকে জানাই।
একই সাথে আমি যত ধরনের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে জড়িত আছি, সব জায়গা থেকে আপাতত বিরতি নিচ্ছি, কারণ আমি চাই না আমার জন্য আমার কোনো বন্ধু বা সহকর্মী বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ুক।
আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী বা অন্য যারা অভিযোগগুলো প্রসঙ্গে আমার কোনো বক্তব্য না পেয়ে বিব্রতকর অবস্থায় ছিলেন, তাদেরকে জানাচ্ছি, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ, আমি প্রতিহিংসার শিকার। আমাকে যদি কেউ আদালতেও নিয়ে যায়, তাহলেও সেখানে এই একই বক্তব্য দেবো আমি।
কথাকলি শুরু থেকেই আমাকে পরামর্শ দিচ্ছিল অভিযোগগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে, কিন্তু আমার নিজের অনীহার কারণে অতদিন তা নেয়া হয়নি। কিন্তু মিথ্যা অভিযোগগুলো যেহেতু দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তাই এখন আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি আইনগত ব্যবস্থার।
যারা আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ ছড়াচ্ছেন, আশা করি আদালতে আপনারা আপনাদের বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করতে পারবেন। আর যদি সেটা না করতে পারেন, তবে অনুরোধ করব ব্যক্তিগত ক্ষোভ, আক্রোশ, প্রতিহিংসার জন্য সিলেটের পুরো সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে বিব্রত করা থেকে বিরত থাকবেন।
ধন্যবাদ।
লিটন