হবিগঞ্জে ফতোয়া দিয়ে নারী নির্যাতনের ঘটনার দ্রুত নিস্পত্তির দাবি

নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০২ পূর্বাহ্ণ
হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে এক নারীর উপর ফতোয়া জারির সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগ তুলে স্থানীয় সালিশে একজন নারীকে ৮২টি বেত্রাঘাত ও ৮০টি পাথর নিক্ষেপ করাসহ ওই নারীকে একমাস ঘরে অবরুদ্ধ থাকার আদেশ ঘোষণা করে। এমনকি সালিশকারীরা ঘোষণা করেন যে, সালিশের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ঘর থেকে বের হলে তাকে আরও ভয়াবহ শাস্তি দেওয়া হবে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে আরও জানা যায় যে, স্থানীয় একজন ব্যক্তি ঐ নারীর উপর ফতোয়ার ৮২টি বেত্রাঘাত এবং সালিশে উপস্থিত অন্যান্য সকলে তার উপর ৮০টি পাথর নিক্ষেপ করে ফতোয়া কার্যকর করেছে। বর্তমান সময়ে এ ধরনের বর্বরোচিত ঘটনা আমাদের ব্যথিত-মর্মাহত এবং চরমভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। এ ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ড বন্ধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।
গত ৪ এপ্রিল রাতে চুনারুঘাটের ফতোয়ার এই ঘটনার সাথে ২০১৭ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের ঘটনার মিল পাওয়া যায়। সেখানেও পরকীয়ার অভিযোগে সালিশে একজন গৃহবধূকে দোররা মারার ঘটনা ঘটেছিলো। এ ঘটনায় পরবর্তীকালে ঐ নারী আত্মহত্যা করে মুক্তির পথ খুঁজে নিয়েছিলো। যদিও চুনারুঘাটের নির্যাতিত নারী থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন।
ইতোপূর্বে এ ধরনের ঘটনায় উচ্চ আদালত স্যুয়োমুটো রুল জারিসহ রিট পিটিশনের প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক রায় প্রদান করার পরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় প্রতিবছরই ফতোয়ার নামে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে।
২০০০ সালে দায়েরকৃত একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগ ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল দায়ের না করলেও কতিপয় ব্যক্তি ধর্মীয়ভাবে ফতোয়ার বৈধতার বিষয়টি উল্লেখে হাইকোর্টের রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে আপিল দায়ের করেন এবং আপিল শুনানী শেষে ১২ মে ২০১১ তারিখে রায় ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এই রায় অনুযায়ী- ধর্মীয় বিষয়ে যথাযথ শিক্ষিত ব্যক্তিরা শুধুমাত্র ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কে ফতোয়া দিতে পারবেন। এই ফতোয়া স্বেচ্ছায় গৃহীত হবে। ফতোয়া মানতে বাধ্য করা যাবে না; (২) কোনো ব্যক্তির দেশে প্রচলিত আেইন দ্বারা স্বীকৃত অধিকার, সম্মান বা মর্যাদা ক্ষুন্ন বা প্রভাবিত করে এমন ফতোয়া প্রদান করা যাবে না; (৩) ফতোয়ার নামে কোনো প্রকার শাস্তি, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না; এবং (৪) উদ্ভুত ফতোয়াটিকে অবৈধ ঘোষণা করে প্রদত্ত হাই কোর্টের রায়টি অবৈধ ও আইন কর্তৃত্ব বহিভুত ঘোষণা করো হয়।
কিন্তু অদ্যাবধি বাংলাদেশ থেকে ফতোয়া বিতাড়িত হয়নি। বরং বহাল তবিয়েতে ফতোয়ার নামে নারী নির্যাতন সংঘটিত হচ্ছে এবং নারীর প্রতি সংঘটিত এ সকল অবমাননাকর ও নির্যাতনের ঘটনায় রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থাগ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে, যা রীতিমতো হতাশা ব্যাঞ্জক।
ফতোয়া সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের অন্যান্য নির্দেশনা থেকে জানা যায়. ফতোয়া প্রদান প্রচলিত আইনে অপরাধ, দোররা বা বেত্রাঘাতের মাধ্যমে আঘাত করা দণ্ডবিধির ৩২৩-৩২৬ ধারায়, অন্যায়ভাবে আটক/চলাফেরায় বাধাপ্রদান/একঘরে করা ৩৪১-৩৪২ ধারার অধীনে অপরাধ। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর বিধান অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং নানাবিধ অপরাধ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং সরকার এ বিষয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা জারি করতে পারবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়ে যে, উচ্চ আদালতের এ সকল নির্দেশনা এখনও পর্যন্ত কার্যকর হয়ে ওঠেনি।
এমতাবস্থায় আমরা নিম্ন বর্ণিত ব্যক্তিগণ অবিলম্বে ফতোয়া বন্ধে কার্যকর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে নারীর সাংবিধানিক ও আইনানুগ অধিকার রক্ষাসহ হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে ফতোয়া দিয়ে নারী নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে দ্রæত বিচার নিষ্পত্তির দাবি জানাচ্ছি। একই সাথে উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি আসুন আমরা সকলে মিলে- যেখানেই বেআইনী সালিশে ফতোয়া ও বিচার বহিভর্‚ত শাস্তি প্রদানের ঘটনা ঘটবে সেখানেই স্থানীয়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলি; ফতোয়া ও বিচার বহিভর্‚ত শাস্তি প্রদানের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করাসহ তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য দাবি তুলে ধরি; এবং
সমাজে ফতোয়া ও বিচার বহির্র্ভুত শাস্তি প্রদানের সাথে যুক্ত এবং এ ধরনের ঘটনায় উৎসাহদানকারীদের সামাজিকভাবে বয়কট করি।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীরা হলেন, ঐক্য ন্যাপ সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য রামেন্দু মজুমদার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত,মহিলা পরিষদ সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ বিরোধী মঞ্চের সদস্য সচিব ড. নুর মোহাম্মদ তালুকদার, বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সভাপতি এস.এম.এ সবুর, মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম. এম. আকাশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ, পারভেজ হাসেম, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট,আবদুল ওয়াহেদ, কার্যকরী সভাপতি, জাতীয় শ্রমিক জোট, ড. সেলু বাসিত, গবেষক ও সংস্কৃতি কর্মী,আব্দুর রাজ্জাক, সাধারণ সম্পাদক, ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ (ইনসাব) ,অ্যাডভোকেট জীবনানন্দ জয়ন্ত, সংগঠক, গণজাগরণ মঞ্চ, এ কে আজাদ, সংস্কৃতি কর্মী, জহিরুল ইসলাম জহির, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, খেলাঘর,জাহাঙ্গীর আলম সবুজ, সমাজ কর্মী, অলক দাস গুপ্ত, সংস্কৃতি কর্মী, সেলিম রেজা, আহবায়ক, সংস্কৃতি মঞ্চ, গৌতম শীল, সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বিসিএল)।