সিলেটের বাজারে অপরিপক্ক মৌসুমী ফল : স্বাস্থ্যঝুঁকির শঙ্কা!

নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ মে ২০২৩, ৮:২৫ অপরাহ্ণ
পুরোপুরি মৌসুম শুরুর আগেই সিলেটের বাজারে উঠেছে অপরিপক্ক লিচু ও আম। বেশি দাম পেতে পাকার আগেই এসব লিচু ও আম বাজারে এনেছেন বিক্রেতারা। লিচু ও আমকে পাকা দেখাতে কেউ কেউ ব্যবহার করছেন কেমিক্যাল-মেডিসিন। যার কারণ এসব ফল দেখে অপরিপক্ক বুঝার কোন সুযোগ নেই। এসব ফলে ইথোফ্যান ও রাইপেন নামের মেডিসিন ব্যবহার করা হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে একদিকে যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে অপরদিকে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ গ্রাহক।
নগরীতে ফলের বাজার মনিটরিং ও ভেজাল বিরোধী অভিযান না থাকায় সকলেই দেদারসে এসব লিচু ও আম ক্রয় করছেন। এতে শিশু ও বয়স্কদের চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিপক্ক ও কেমিক্যাল মিশানো লিচু স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের এ থেকে দুরে রাখা উচিত। অন্যথায় যেকোন বিপদ হতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, মে মাসের ২০ তারিখের পর সাধারণত বাজারে পরিপক্ক লিচু আসে। এই সময়ে সিলেটের স্থানীয় লিচু ও মাদ্রাজী লিচু বাজারজাত হয়। আর জুন মাসের ১০ তারিখের পর বাজারে সিলেটের বাইরে থেকে বেদেনা জাতের লিচু, ২০ জুনের পর বোম্বে এবং এরপরের সপ্তাহে চায়না থ্রি লিচু বাজারে আসে। সবশেষে বাজারে আসবে কাঁঠালি ও মোজাফ্ফর লিচু।
অথচ নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাজারে উঠেছে লিচু। ইতোমধ্যে সিলেট নগরীর বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, আম্বরখানা, সুবিদবাজার, মদীনা মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় লিচু বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। লকেল লিচু বলে এসব লিচুর শ’ ২০০-২৫০ টাকায় বিক্রি করছেন তারা।
এদিকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সিলেটের তথ্যমতে, বাজারে ৪ মে থেকে গুটি আম, ১৫ মে গোপালভোগ, ২০ মে থেকে লক্ষণভোগ, ২৫ মে থেকে হিমসাগর, ৬ জুন থেকে ল্যাংড়া, ১৫ জুন থেকে ফজলি, ১০ জুন থেকে আম্রপালি ও ১০ জুলাই আশি^না আম আসার কথা রয়েছে। এছাড়া সিলেটের বাইরে থেকে আর কয়েক জাতের আম বাজারে আসে। ভালো জাতের আম সাধারণত মে মাসের ২০ তারিখের পর বাজারজাত হয়ে থাকে। এর আগে বাজারে এসব নাম ব্যবহার করে অন্যজাতের আম বিক্রি করা হয়ে থাকে। যা গ্রাহকদের সাথে সুষ্পষ্ট প্রতারণা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মধুমাস জ্যৈষ্ঠের বেশ কয়েকটি অভিজাত ফল রয়েছে। বাঙালির কাছে চিরচেনা এবং সুস্বাদু সেই ফলগুলোর মধ্যে আম, জাম, কাঁঠাল ও লিচু অন্যতম। মে মাসের ১ম সপ্তাহেই সিলেটের বাজারে কয়েকটি ফল আসতে শুরু করে। এর মধ্যে লিচু ও আমের আধিক্য বেশি। সাথে রয়েছে কাঁঠাল। তবে এই সময়ে বাজারে কিছু আমের দেখা মিললেও সেগুলো কার্বাইড মিশ্রিত, যা শিশুদের জন্য নিরাপদ নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। রাজশাহী কিংবা চাঁপাইনবাবগঞ্জের উন্নতজাতের সেই আমগুলো এখনো বাজারে আসেনি বলে জানিয়েছেন কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা।
মে মাসের ১ম দিক থেকে সিলেটের বাজার দখল করে রেখেছে লিচু। জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার কিংবা আম্বরখানার সবগুলো ফুটপাত কিংবা দোকানে রয়েছে লিচুর সরব উপস্থিতি। ব্যবসায়ীরা সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা কাঁচা, আধাপাকা লিচুর পসরা সাজিয়ে রেখেছেন। লিচুর দামও তুলনামূলক বেশি। ক্রেতাদের অধিক আগ্রহ নিয়ে নতুন লিচু কিনতে দেখা গেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে বাজারে বেশি লিচু আসার অন্যতম কারণ হচ্ছে এ ফলটি গাছে বেশিদিন টিকে না। খুব অল্প কিছুদিন বাজারে দাপট থাকে লিচুর। অতিরিক্ত বৃষ্টি, ঝড়-তুফানের সাথে শিলাবৃষ্টি হলেই লিচু বিনষ্ট হবার আশঙ্কা থাকে। এজন্য গাছে আসার কিছুদিনের মধ্যে এ ফলটি বাজারে চলে আসে। এছাড়া, সিলেটের ছাতক, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, কুলাউড়াসহ বেশ কয়েকটি উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে লিচু চাষ হয়ে থাকে। তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে ছাতকের মানিকপুর গ্রাম। এ গ্রামের সবগুলো পরিবারই বাণিজ্যিকভাবে লিচু চাষ করে আসছেন বেশ কয়েকবছর ধরে। মানিকপুর ছাড়াও ছাতকের আরো কয়েকটি গ্রামে একইভাবে বাণিজ্যিক লিচু চাষ হয়ে আসছে। সিলেটে লিচু বাণিজ্যিকভাবে চাষ হবার কল্যাণে বাজারে লিচুর অবাধ বিচরণ লক্ষ্য করা গেছে। সেই সাথে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকেও বর্তমানে লিচু আসা শুরু হয়েছে বলেও জানান তারা। এসব লিচুর স্বাদ নিয়েছেন কিংবা খেয়েছেন এমন কয়েকজন ক্রেতা জানান, বর্তমানে লিচু এখনও টক। মিষ্টতা আসেনি। আঁটি ভরপুর হয়নি। তবু নতুন ফল হিসেবে কিনেছিলাম। তবে ভালো লাগেনি।
হকার্স মার্কেটের সামনে দেখা গেছে, সাদা ও লালচে লিচু নিয়ে বসেছেন কয়েকজন ফল বিক্রেতা। দিনাজপুরের লিচু, মিষ্টতায় ভরপুর, দাম মাত্র আড়াইশ টাকা। এভাবেই হাঁকডাক দিয়ে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন তারা।
সেখানে কথা হয় রিপন আহমেদ নামের এক বিক্রেতার সঙ্গে। তিনি বলেন, নতুন ফল বাজারে উঠেছে। তাই দাম বেশি। কেউ কেউ কিনছেন, অনেকে কিনছেন না।
এবার এক সপ্তাহ আগে লিচু পেকেছে দাবি করে এই বিক্রেতা বলেন, বৃষ্টি নেই, প্রচণ্ড রোদ। এই তাপে লিচু পেকেছে। ১০০ লিচু ২০০-২৫০ টাকা বিক্রি করছি। দিনাজপুর থেকে ৩ ঝুড়ি লিচু এনেছিলাম। এছাড়া সিলেটের স্থানীয় লিচুও দুয়েকদিন বিক্রি করেছি। দিনাজপুরের লিচুর স্বাদ ভালো হলেও সিলেটের স্থানীয় লিচু খেয়ে অনেক ক্রেতা অভিযোগ করেছেন তাই এখন সিলেটের বাইরে লিচু বিক্রি করছি বলেও জানান ঐ বিক্রেতা।
লিচু ক্রেতা সফিকুল ইসলাম বলেন, নতুন ফল বাজারে উঠেছে, তাই ১০০টি কিনলাম ২৩০ টাকায়। খেয়ে দেখেছি, টক। টক হলেও সমস্যা নেই, ভিটামিন সি। পরিবারের সবাই খাবে, খুশি হবে। এটি অপরিপক্ব কিনা তা আমার জানা নেই।
দাম একটু বেশি তবু নতুন ফল দেখে কিনলাম উল্লেখ করে ক্রেতা আলাল মিয়া বলেন, এসব লিচু সাদা ও লালচে। দেখে মনে হচ্ছে পুরোপুরি পরিপক্ব হয়নি।
দামাদামি করেও বেশি হওয়ায় কেনেননি নগরীর বাসিন্দা মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ক্ষতি কতটুকু জানি না। যদি বিষ না দিয়ে থাকে তাহলে তেমন ক্ষতি নেই। দাম বেশি, এজন্য কিনিনি। আরও কয়েকদিন পর কিনবো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আম্বরখানা বাজারের এক ফল ব্যবসায়ী জানান, এখনো স্থানীয় লিচু পাকেনি। তবে বাজারে উঠেছে। দাম বেশি। আমরা ১৯০ টাকায় শ কিনে বিক্রি করছি ২২০-২৫০ টাকায়। তবে লিচু বাজারে উঠার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। মাদ্রাজি লিচু বাজারে উঠেছে, আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই বেদানা লিচু বাজারে আসবে।
বাগান থেকে লিচু নিয়ে এসেছি দাবি করে বন্দরবাজারের এক লিচু বিক্রেতা বলেন, এবার বাগানে ফল কম। তবে চাহিদা আছে। সামনে আরও দাম বাড়বে। আবহাওয়ার কারণে এবার আগেভাগেই লিচু পেকেছে। তবে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পুরোপুরি পাকবে। লিচুতে ফরমালিন কিংবা কীটনাশক দেওয়া হয় না। তবে বাজারে আসা লিচুতে মিষ্টতা কম, একটু টক। কয়েকদিন পর আর টক লাগবে না, পাকলে পুরোপুরি মিষ্টি হবে।
অপরিপক্ক লিচু স্বাস্থ্যের জন্য তেমন ক্ষতিকর না হলেও কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো লিচু-আমসহ যে কোন ফল স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি বলে জানিয়েছেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাজারে নতুন লিচু উঠেছে দেখেছি। তবে লিচু যদি অপরিপক্ক হয় আর মিষ্টি হয় তাহলে সেই লিচুতে তেমন ক্ষতি হবেনা। তবে এসব লিচু বাচ্চাদের না খাওয়ানো ভালো। আর বাজারের যেসব লিচু দেখতে পাকা লাল মনে হবে কিন্তু স্বাদ পাওয়া যাবেনা সেসব লিচুতে মেডিসিন দেয়া হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। এরপরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক লিচুকে পরীক্ষা করে দেখা উচিত।
এ বিষয়ে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী জানান, বর্তমানে বাজারে থাকা লিচু ক্ষতিকর কি না তা এই মুহুর্তে বলা ঠিক হবেনা। অবশ্যই এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে তারপর মন্তব্য করা উচিত। তিনি বলেন, শুধু লিচু নয়, যে কোন ফলে কেমিক্যাল ব্যবহৃত হলে সেগুলা বিষাক্ত হয়ে উঠে। এক্ষেত্রে শিশু ও বয়স্কদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। কিন্তু পরীক্ষা না করে ঢালাওভাবে লিচুতে কেমিক্যাল মিশানো হয়েছে সেটাও বলা ঠিক হবেনা।
এ ব্যাপারে সিলেটের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা আবু সালেহ মোঃ হুমায়ুন কবির বলেন, সিলেটের বাজারে লিচু ও উন্নত জাতের আম সাধারণত ২৫ মে’র পরে আসে। এর আগে যেসব লিচু ও আম বাজারে আসে সেগুলাতো স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকাটা স্বাভাবিক। কারণ সিলেটের বাইরে থেকে আম বাজারে আসার নির্দিষ্ট তারিখ সেখানের ব্যবসায়ীরা আমাদেরকে দিয়ে রেখেছেন। এর আগে তারা আম বাজারজাত করবেনা। এখন সিলেটের বাজারে মূলত গুটি আম ও গোপালভোগ আম থাকার কথা। এছাড়া আগামী সপ্তাহে লক্ষণভোগ আসবে। হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলি, আম্রপালি ও আশি^না আম এখনো বাজারে আসতে অনেক দেরি আছে।
অপরিপক্ক লিচুতে বদহজম ছাড়া তেমন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন সিলেটের ডেপুটী সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় শংকর দত্ত। তিনি বলেন, কেমিক্যাল যুক্ত লিচুসহ যে কোন ফল স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। অপরিপক্ষ লিচুতে বাচ্চা ও বয়স্কদের বদহজম জনিত সমস্যা হতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেটের উপপরিচালক কাজী মোঃ মজিবুর রহমান বলেন, সিলেটের বাজারে থাকা লিচু ও আম পরীক্ষা না করলে ক্ষতিকর বলার সুযোগ নেই। দেশে এখন আগাম জাতের লিচু ও আম চাষ হচ্ছে ফলে সময়ের আগেই পেকে যায়। বাজারে থাকা লিচু ও আমগুলো দেখলে বুঝা যাবে তা অপরিপক্ক নাকি আগাম জাতের।
তিনি বলেন, সিলেট বিভাগের কয়েকটি উপজেলায় লিচু চাষ হলেও তা বাণিজ্যের জন্য পর্যাপ্ত নয়। তাই সিলেটের বাইরে থেকে আসা লিচুতেই সাধারণ মানুষের চাহিদা পূরণ হয়। অনেক সময় বাইরে থেকে আসা লিচুতে ক্ষতিকারক কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু সিলেটের স্থানীয় ব্যবসায়ী কর্তৃক কেমিক্যাল মিশানোর সম্ভাবনা কম।
বিএসটিআই সিলেটের উপপরিচালক (মেট্রোলজি) মো. লুৎফুর রহমান বলেন, ফলমূলের ক্ষেত্রে একসময় ফরমালিন সমস্যা প্রকট হয়ে পড়েছিল। তখন আমরা জোরালো অভিযান পরিচালনা করেছি। তবে এখন ফল পাকানোর জন্য ইথোফ্যান ও রাইপেন নামের মেডিসিন ব্যবহার করা হয়। এই মেডিসিন তেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। কারণ এগুলা ফলের গায়ে ব্যবহারের পর এমনিতেই বাতাসে উড়ে যায়। এরপরও ফলে যেকোন ধরনের মেডিসিন ব্যবহার করা বেআইনী ও দণ্ডনীয় অপরাধ। এক্ষেত্রে আমরা সব সময় জিরো টলারেন্সে আছি।
তিনি বলেন, বর্তমানে বাজারে যে লিচু ও আম এসেছে এগুলা অপরিপক্ক হলেও ক্ষতিকর কেমিক্যাল নেই। গেল রমজানে বাজারে কেমিক্যাল মিশ্রিত ভেজাল আম উঠেছিল। আমরা অভিযান চালিয়ে সেই আম নষ্ট করেছি এবং পরবর্তীতে বিক্রি করতে নিষেধ করেছি। বর্তমানেও ফলের বাজারের উপর আমাদের নজর রয়েছে। আমরা শীঘ্রই এ নিয়ে অভিযানে নামবো। লিচু কেনার ক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়ে কিনতে হবে। যেসব লিচু দেখতে চকচকে কিন্তু খেতে মিষ্টি নয় সেসব লিচু না কিনাই ভালো।