সৈদ্দুনুর স্যারের মৃত্যু ও কিছু স্মৃতি

নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জুন ২০২৩, ১০:৪৬ অপরাহ্ণ
সৈদ্দুনুর স্যার(Syedun Noor Ahmed)নেই! ভাবতে অবাক লাগে। কোর্ট থেকে এসে সন্ধ্যার পর ঘুমে।মাসুক ভাইয়ের(মাসুক আহমদ তাহের) ফোনে আমার ঘুম ভাঙ্গে।ফোন রিসিভ করতেই মাসুক ভাই বলেন-‘মনির সৈদ্দুনুর মারা গেছে’…আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই।কথা বলতে পারি না।দেহ ও মনে অন্যরকম অনুভব করি।একধরণের অস্থিরতা অনুভূত হয়।বিষন্ন হয়ে যাই।বিছানা থেকে উঠে বসি।স্থির থাকতে পারি না।কী করি ভেবে পাচ্ছি না।নিশ্চিত হওয়ার জন্যে ফোন হাতে নেই।কাকে ফোন করে নিশ্চিত হবো চিন্তা করি।মনে হলো-সৈদ্দুনুর স্যার-এর ফোনে ফোন করি।পরে ভাবলাম ঠিক হবে না।মৃত ব্যাক্তির ফোনে ফোন করতে বিচলিত বোধ করি।কার কাছ থেকে সংবাদ জেনে নেবো ভাবতে থাকি।পরে ফেসবুক-এ সাইন ইন করে দেখি-সুপ্রভা দি’র(Suprova Rani Kar)পোস্ট।এবং তৎক্ষণাৎ দিদি-কে ফোন দেই।তিনি ও আমি উভয়েই ভারাক্রান্ত,বিষণভাবে ব্যথিত।কিছুক্ষণ স্মৃতিচারণ হয়।কথা বেশি সময় চালিয়ে যেতে ইচ্ছা করেনি।ফোনালাপ শেষ করে বাসার চেম্বারে বসে ভাবতে থাকি।বারবার স্মৃতি ভেসে উঠছে।আজ আবার রাত নয়টায় কলেজ স্থাপন উদ্যোক্তা কমিটির ভার্চুয়াল মিটিং।
যথারীতি মিটিং-এ ভার্চুয়ালি যুক্ত হই।মিটিং-এ এই মৃত্যু নিয়ে আলোচনা হয়।স্মৃতিচারণমূলক কথাবার্তা।প্রায় সবাই স্যার-এর সাথে পরিচিত।সভায় শোক প্রকাশ করা হয়।ভার্চুয়াল মিটিং চলাবস্থায় ইসলামপুরের আলী আহমেদ ভাইয়ের ফোন।মিটিং-এ অনুমতি নেই।মিউট করে ফোন রিসিভ করি।আলী আহমেদ ভাই বলেন-‘শুনলাম সৈদ্দুনুর মারা গেছে’ ঠিক কি-না?আমি বলি-ঠিক আছে ভাই।নিশ্চিত হয়েছি।কথা সংক্ষেপ করি।পরে দ্রুত কলেজ স্থাপন উদ্যোক্তা কমিটির ভার্চুয়াল মিটিং সমাপ্ত করি।আবারও ভাবনায় নিপতিত হই।বিচলিত বোধ করি।শুধু স্মৃতিগুলো মনে পড়ে…সৈদ্দুনুর স্যারের সাথে আমার অনেক স্মৃতি!
সৈদ্দুনুর স্যার এবং লতিফ ভাই(Oi Latif) ১৯৯২ সালের শেষের দিকে একটি কোচিং সেন্টার খোলেন আমবাড়ী বাজার-এ।কোচিং এর নাম ‘নিউক্লিয়াস কোচিং’।সৈদ্দুনুর স্যার তখন গ্রেজুয়েশন শেষ করে চাকরি-বাকরি’র চেষ্টা করছেন।এবং লতিফ ভাই নটরড্যাম কলেজ ঢাকা থেকে ইন্টারমেডিয়েট শেষ করে বা পরীক্ষা দিয়ে আমবাড়ী আছেন।দু’জন মিলিত হয়ে সাময়িক সময়ের জন্যে কোচিং চালাচ্ছেন।একদিন আমাকে ডেকে নিলেন উভয়েই।বললেন-‘কোচিং-এ গিয়ে ক্লাস করতে।এসএসসি পরীক্ষার ফরমফিলাপ শেষ।স্কুলে ক্লাস নেই।ফলে আমি রাজি হই।ক্লাস করি।অন্যরাও ভর্তি হয়ে কোচিং করে।মূলত অনেকটা ফ্রি সার্ভিসের মতো।তাঁরা গণিত ও ইংলিশ পড়াতেন।দুই-আড়াই মাস তাদের সংস্পর্শে থেকে শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করি।এই থেকে উভয়ের সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হয়।ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে।উভয়েই মেধাবী,বেশ বুদ্ধিমান মানুষ,অসাম্প্রদায়িক এবং প্রগতিশীলও বটে।কিছুদিনের মধ্যেই সৈদ্দুনুর স্যার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।আমি ১৯৯৩ সালে এসএসসি পাশ করে সিলেট চলে আসি।লতিফ ভাই চলে যান ঢাকা।সিলেট থেকে বাড়িতে গেলে সৈদ্দুনুর স্যারের সাথে সাক্ষাত হয়।বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করি।আমাকে ছোটোখাট চাকরি না-নেওয়ার জন্যে বলেন।
উচ্চশিক্ষা গ্রহণের তাগিদ দেন।সিলেট থেকে বাড়িতে গেলেই আমি স্যারের সাথে সাক্ষাত করি।জীবন-জীবিকা,সমাজ বাস্তবতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করি।যে-কোনো বিষয়ে আলাপ করে অনেক ভালো লাগতো।অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল একজন মানুষ ছিলেন।ছিলেন-বুদ্ধিদীপ্ত ও স্পষ্টভাষী বিচক্ষণ একজন নিভৃতচারী মানুষ।এমন মানুষ আমাদের এলাকায় সংখ্যায় নগণ্য।অনেকটা নেই বললেই চলে।শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান মানুষের সাথে কথা বলতে ও আড্ডা দিতে পছন্দ করতেন।স্যারের কথাবার্তা চলাফেরা দেখে মাঝেমধ্যে আমার মনে হতো-সাম্যবাদি রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত না-থেকেও একজন মানুষ সাম্যবাদি হতে পারেন,আবার সাম্যবাদি রাজনৈতিক দলের সদস্য হয়েও,সাম্যবাদি নাও হতে পারেন।
শিক্ষা অন্তপ্রাণ মানুষ ছিলেন।আমবাড়ী এলাকায় একটি কলেজ স্থাপন বিষয়ে যখন স্যারের সাথে আলাপ করি।তিনি সীমাহীন আনন্দিত হন।এবং অবাক হন!আমাদের পরিকল্পনা তাঁর শেয়ার করি।তখন আশ্বস্থ হন-আমরা কলেজ করতে পারবো।এতৎবিষয়ে অনেক পরামর্শ দেন।শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই বলেন।মানুষ-কে অন্ধকার থেকে বের করতে হলে শিক্ষাই উত্তম মাধ্যম বলেন।নীরবে নিভৃত্বে তিনি জ্ঞানচর্চা করতেন।মেধাবী ও জ্ঞানী মানুষের সঙ্গ বিষণভাবে পছন্দ করতেন।গত বছর বন্যার সময় ‘দুর্গতদের সেবায় আমার’ পক্ষ থেকে ২২০০ জন আশ্রয় কেন্দ্রের লোকজনকে তিনদিন আমরা রান্না করা খাবার সরবরাহ করি।আমাদের কর্মসূচি ও খাদ্য সহায়তায় তিনি অভিভূত হয়েছিলেন।বন্যা পরবর্তী সময়ে আমরা আর্থিকভাবে অনগ্রসর শিক্ষার্থীদের মধ্যে খাতা,কলম,ক্যালকুলেটর, জ্যামিতি বক্স প্রাইমারি স্কুল,হাইস্কুল,মাদ্রাসায় সরবরাহ করি।প্রায় ২৪/২৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই শিক্ষাউপকরণ সহায়তা প্রদান করা হয়।উপকরণ বিতরণ করার সময় আমি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের সাথে কথা বলি।সৈদ্দুনুর স্যার জালালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক,এই হিসেবে তাকে ফোন করি।এবং বলি-আপনার স্কুলের ৬০জন শিক্ষার্থীদের তালিকা করেন।যারা তুলনামূলক আর্থিকভাবে অ-স্বচ্ছল।এই কর্মসূচি দেখে তিনি চমৎকৃত হন।বলেন-‘আমি অভিভূত’।অনেক ধন্যবাদ জানালেন।কয়েকদিন পর স্যার-কে ফোন করি।বলি-‘স্যার আপনার স্কুলে শিক্ষাউপকরণ নিয়ে আসতে চাই’।তিনি বলেন-‘রাস্তা ভালো না,গাড়ি আসবেনা’।আমি বলি-‘তাইলে কী করবো স্যার’।তিনি বলেন-‘আমি ব্যবস্থা করবো অথবা আমি নিয়ে যাবো’।আমি পরে ‘দুর্গতদের সেবায় আমরা’-এর স্বেচ্ছাসেবক আফজল-কে(Mohammed Afzal)ফোনে বলি-‘সৈদ্দুনুর স্যারের সাথে যোগাযোগ করতে’।আফজল যোগাযোগ করে-শিক্ষাসামগ্রী স্যারের কাছে সরবরাহ করে।স্যার শিক্ষাউপকরণ বিতরণ করে ফোনে আমাকে অবহিত করেন।এবং বলেন-তাঁর শিক্ষার্থী অনেক আনন্দিত ও অভিভাবকরাও।আমাদের সংশ্লিষ্ট সকলকে স্যার ধন্যবাদ জানান।এবং ভবিষ্যতে এ ধরণের জনহিতকর কাজ অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন।
আমবাড়ী গেলেই স্যারের সাথে সাক্ষাত ও কথা হয়।একদিন আমাকে বলেন-‘সিলেটে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে এসেছি’।আমি বলি-‘সিলেট গেলেন অথচ আমাকে জানালেন না’।
তিনি বলেন-‘বিরক্ত করতে ভালো লাগে না তাই ফোন করিনি’।স্যারের শারিরীক অবস্থা ভালো ছিল না,দেখলেই অনুমান করা যেতো।হার্টের সমস্যা ছিলো।যথাযত চিকিৎসা নিতে পারেন নি।আমাদের দেশে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকগণ যে-বেতন ভাতা পান।তা-দিয়ে খেয়েদেয়ে বাঁচা যায় না!উন্নত চিকিৎসা করাবেন কীভাবে?ফলে হয়তো যথাযথ চিকিৎসা নিতে পারেন নি।এছাড়া তিনি কিছুটা অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন করেছেন।ছাত্রজীবন থেকে প্রচুর ধুমপান করতেন।একের পর এক বিড়ি-সিগারেট ফুঁকতেন।এমন চেইন স্মোকার আমবাড়ী এলাকায় আছেন কি-না আমার জানা নেই!ফলে অকালেই চলে যেতে হলো!
সৈদ্দুনুর স্যার,লতিফ ভাই এবং নজরুল ভাই(M N Gony Nazrul)একসময় এক সাথে চলতেন।পারস্পরিক অন্তরঙ্গ ছিলেন।দিনেরাতে আড্ডা দিতেন।তাদের সাথে আমারও কিছুটা সংশ্লিষ্টতা এক পর্যায়ে গড়ে উঠে।ফলে সবার খোঁজখবর আমি রাখতাম এবং তাঁরাও রাখতেন।লতিফ ভাই নটরড্যাম কলেজে পড়েও,শিক্ষাজীবন এলোমেলো হয়ে যায়।কোনো রকম গ্রেজুয়েশন করেন।লতিফ ভাই ১৯৯৭ সালে সিলেটে চলে আসেন।তখন লতিফ ভাইয়ের সাথে আমার দেখা-সাক্ষাত প্রায়ই হতো।পরে তিনি এনজিও-তে চাকরি নেন।সিলেট থেকে মফস্বলে চলে যান।সিলেট আসলেই আমার মেস-এ উঠতেন,পরবর্তীতে একক ও সপরিবারে বাসায় এসেছেন।পারিবারিক যোগাযোগও ছিল।এখনও পরিবারের সাথে আমার যোগাযোগ আছে।আকস্মিকভাবে একেবারে অকালে লতিফ ভাই মৃত্যুবরণ করেন।বছর দু-এক আগে।নজরুল ভাই পারি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র।নজরুল ভাইয়ের সাথে ভার্চুয়ালি যোগাযোগ আছে।সৈদ্দুনুর স্যারের সাথেও যোগাযোগ ছিলো।এখন দু’জন হারিয়ে গেলেন চিরতরেই!
সৈদ্দুনুর স্যার এ-ভাবে অবেলায়-অকালে চলে যাবেন-আমি ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারিনি।একজন ভরসার মানুষ ছিলেন তিনি।এলাকায় গেলেই সাক্ষাত করতাম।সব বিষয়ে আলাপ করা যেতো।জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমজদার লোক ছিলেন।যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা করতেন।যে-কোনো বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ মতামত বা পরার্মশ দিতেন।আমাদের এলাকার মধ্যে একজন বিচক্ষণ জ্ঞানী মানুষ ছিলেন।অনেকেই হয়তো তাকে মুল্যায়ন করতে পারেন নি।কিন্তু যারা চিনেছেন,তাঁরা বোঝেছেন,তিনি কী ছিলেন।তিনি আসলে তাঁর অবস্থানে সন্তুষ্ট ছিলেন না,ফলে গা-ছাড়া ভাবে চলতেন।আসলে তাঁর জ্ঞান ও মেধানুসারে পেশাজীবনে আরও অধিকতর উন্নত আসনে আসীন হওয়ার কথা ছিলো।সমাজ বাস্তবতার যাতাকলে পিষ্ঠ হয়ে অগ্রসর হতে পারেন নি।ফলে ছিলেন কিছুটা উদাসীন!যাই হোক-শেষ পর্যন্ত মানুষ গড়ার কারিগর মহান শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।মানুষের মাঝে ও তাঁর শিক্ষার্থীদে মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন,স্মরণীয় থাকবেন।
১১জুন,২০২৩ রোববার রাত ০৮টার সময় প্রিয়-শ্রদ্ধেয় সৈদ্দুনুর স্যার সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার নিজ গ্রাম আমবাড়ী-তে মৃত্যুবরণ করেন।
শেষ বিদায়ে উপস্থিত হতে পারিনি।ক্ষমা করবেন স্যার।আমার জন্যে কষ্ট ও বেদনার।কিছু কিছু মানুষ-কে মৃত্যু কাঁদায়,অনুভূতি শুণ্য করে দেয়!সৈদ্দুনুর স্যারের অকালে মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা জানাই।
—————————————————————————
১২জুন,২০২৩,সোমবার॥জজকোর্ট,সিলেট