ঐতিহ্যের হারিকেন বিলুপ্তির পথে

মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ আগস্ট ২০২৩, ৫:১২ অপরাহ্ণ
সমাজ পরিবর্তন, বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী হারিকেন এখন বিলুপ্তির পথে। হারিকেন নিয়ে ছন্দের সুরে বলতে হয়, ‘যখন তোমার কেউ ছিল না তখন ছিলাম আমি, এখন তোমার সব হয়েছে পর হয়েছি আমি’ বৈদ্যুতিক বাতি, চার্জার ও বিদ্যুতের নানা ব্যবহারের ফলে হারিকেনের ব্যবহার আজ আর দেখা যায় না। প্রবীণদের মতে, একসময় হারিকেন দেখতে যেতে হবে জাদুঘরে। নতুন প্রজন্ম হয়তো জানবেও না হারিকেনের ইতিহাস!
গ্রামীণ জনপদের মানুষের কাছে একসময় হারিকেনই ছিল একমাত্র আলোর উৎস। সন্ধ্যা হলে হারিকেন নিয়ে পড়তে বসত শিশুরা। বাসগৃহের আলোর সন্ধান, বাজারের দোকানদারি এমনকি রাতে চলাফেরা করার জন্যও হারিকেন ছিল গ্রামের মানুষের একমাত্র অবলম্বন। তবে এখন প্রযুক্তির ফলে মানুষকে হারিকেন ছেড়ে এখন বিদ্যুতের দিকে ঝুঁকছে।
হারিকেনের বর্ণনা পাওয়া যায় কমলগঞ্জ উপজেলার উত্তর আলেপুর গ্রামের বয়োবৃদ্ধা মন্নান মিয়ার কাছে। তিনি বলেন, ‘ছোট থাকতে আমি সন্ধ্যাবেলা হারিকেনের কাচের চিমনি খুলে, ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে কেরোসিন তেল ঢেলে দিয়াশলাই দিয়ে আগুন জ্বালাতাম। হারিকেনের কেরোসিন তেল রাখার জন্য গ্রামের সব বাড়িতেই কাচের বোতলের গলায় রশি লাগিয়ে বাঁশের খুঁটিতে ঝুলিয়ে রাখা হতো।’ পৌর এলাকার পানিশালা গ্রামের সাবেক শিক্ষক ঝুলন চক্রবর্তী বলেন, ‘ছোটবেলায় আমরা ল্যাম্প কিংবা হারিকেনের মৃদু আলো জ্বালিয়ে ছাত্রদের লেখাপড়া করিয়েছি। বাতাসের ঝাপটায় কখনো কখনো আলো নিভে গেছে। আবার দিয়াশলাই অথবা ছাত্র বানসার চুলার আগুনে পাটকাঠি দিয়ে আলো জ্বালিয়ে পড়ালেখা শুরু করাতাম।’ তিনি বলেন, ‘ছোট থাকতে আমি সন্ধ্যাবেলা হারিকেনের কাচের চিমনি খুলে, ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে কেরোসিন তেল ঢেলে দিয়াশলাই দিয়ে আগুন জ্বালাতাম। হারিকেনের কেরোসিন তেল রাখার জন্য গ্রামের সব বাড়িতেই কাচের বোতলের গলায় রশি লাগিয়ে বাঁশের খুঁটিতে ঝুলিয়ে রাখা হতো।’
একই এলাকার রিকশাচালক চনু মিয়া বলেন, আমি রিকশা চালাতাম। এখনো চালাই। কিন্তু আগে আমরা রাতে রিকশার নিচে হারিকেন লাগিয়ে রাখতাম রাস্তার পথ দেখার জন্য। তখন রাস্তা ঘাটে বিদ্যুৎ ছিল না। ২৫০ গ্রাম কেরোসিনে সারা রাত চলে যেত। এখন আর সেটা লাগে না।
কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ বাজারের স্থানীয় দোকানদার হারুন মিয়া বলেন, ১৫ থেকে ২০ বছর আগে সন্ধ্যায় কেরোসিন তেল নেওয়ার জন্য মানুষের সিরিয়াল থাকত। গ্রামাঞ্চলের সেই ঐতিহ্যবাহী হারিকেন আজ বিলুপ্তির পথে। এখন পুরো বাজারে মুদির দোকানে কেরোসিন তেল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। হয়তো নতুন প্রজন্ম হারিকেন সম্পর্কে জানবে না, পড়তে হবে ইতিহাস। হতে পারে একসময় হারিকেনের দেখা মিলবে জাদুঘরে।
শ্রীমঙ্গল এলাকার ৭০ বছর বয়সি রিকশাচালক খাজা মিয়া বলেন, আমি এখন রিকশা চালাতে পারি না। তবে আজ থেকে ২০ বছর আগেও আমি যখন রিকশা চালাই তখন লেমটন (হারিকেন) ছাড়া রাতে চালানো যেত না। তখন লেমটন ব্যবহার করতে হতো। আমরা রিকশার নিচে পেডেলের পাশে এটা বসিয়ে রিকশা চালাতাম। ১০ টাকার কেরাসিন তেল দিয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টা চালানো যেত রিকশা। কুলাউড়া উপজেলার নসিরগঞ্জ বাজার প্রবীণ ব্যবসায়ী মল্লিক চন্দ্র বলেন, যুগের কারণে কত কি পরিবর্তন হয়েছে আর হারিকেন তো সামন্য বিষয়। আমরা রাতে বাজার থেকে যাওয়ার পথেও একসময় হারিকেনের আলো জ্বালিয়ে বাড়িতে যাইতাম। এখন আর তা নেই। এটা অতীত এখন।