টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রশাসনের নির্দেশনা

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি :
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ আগস্ট ২০২৩, ৮:৫৩ অপরাহ্ণ
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর। কিন্তু দর্শনার্থীদের অপরিকল্পিত ও আকস্মিক ভ্রমণ হাওরের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য হুমকি তৈরি করছে। এজন্য হাওরের সম্পদ, জীববৈচিত্র ও পরিবেশ সংরক্ষণ, পর্যটকদের নিরাপত্তা বিধানে কিছু নির্দেশনা জারি করেছে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন। দর্শনার্থীদের মাত্রাতিরিক্ত এবং যত্রতত্র ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ট্যুর অপারেটর, নৌযান/হাউসবোট মালিক ও পরিচালকদের প্রতি এই নির্দেশনা বলবত থাকবে।
নির্দেশনাগুলো হলো : নির্দিষ্ট শর্তাবলি পূরণসাপেক্ষে জেলা প্রশাসন বরাবর আবেদন করে প্রাথমিক রেজিস্ট্রেশন/অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে। প্রাথমিক অনুমোদন গ্রহণের ৩ মাসের মধ্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নৌযানসমূহের নিবন্ধন ও জরিপ কার্যক্রম সম্পন্ন এবং রুট পারমিট গ্রহণ করে (অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল সংক্রান্ত যাবতীয় আইন ও বিধানাবলী অনুযায়ী) জেলা প্রশাসন হতে চুড়ান্ত অনুমোদন/রেজিস্ট্রেশন গ্রহণ করতে হবে। নৌযান সংশ্লিষ্ট যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত ডিজাইন অনুযায়ী তৈরীকৃত হতে হবে। নৌযানের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী নির্ধারিত সংখ্যক ট্যুরিস্ট, তাদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম ও লাইফ জ্যাকেট রাখতে হবে। নৌযানে অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা ও প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রী থাকতে হবে। এসবের কার্যকারিতা যাত্রা শুরুর আগে নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে। প্রশিক্ষিত মাঝি বা সুকানী দ্বারা নৌযান পরিচালনা করতে হবে।
হাওরের জীব বৈচিত্র রক্ষা ও সার্বিক পরিবেশ, প্রতিবেশ সংরক্ষণে প্রতিদিন কেবলমাত্র জেলা প্রশাসন কর্তৃক অনুমতিপ্রাপ্ত নির্দিষ্ট সংখ্যক নৌযান হাওরে পর্যটক বহন করতে পারবে। জেলা প্রশাসন নৌযানের তালিকা হতে পর্যায়ক্রমে পর্যটক বহন করার জন্য নৌযান বাছাই করবে। স্বাভাবিক মাত্রার অধিক শব্দ সৃষ্টিকারী, অতিরিক্ত/কালো ধোঁয়া উদগীরণকারী বা ত্রুটিপূর্ণ জলযান পর্যটক পরিবহনে ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে এবং পর্যটকবাহী নৌকা/জলযানে বর্জ্য রাখার ব্যবস্থা রাখতে হবে। পর্যটকবাহী নৌযানে সৌর শক্তি ব্যবহারে সচেষ্ট থাকা, হাওরের অভ্যন্তরে উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী জেনারেটর বহন থেকে বিরত থাকা এবং রাত ১০টার পর জলযানে ব্যবহৃত জেনারেটর বন্ধ রাখতে হবে। নৌকা/ জলযানে নিরাপদে ওঠানামার জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। পর্যটকবাহী নৌযানে রাত্রিকালীন অবস্থানের ক্ষেত্রে অনুমোদিত সংখ্যক পর্যটকের বেশি পর্যটক বহন করা যাবে না। হাওরে যত্রতত্র লঞ্চ/জলযান নোঙ্গর করা যাবে না। রাত্রিকালীন অবস্থানের ক্ষেত্রে স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিতকরণসহ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধ সংঘটিত হতে দেখা গেলে বা আলামত পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করা এবং অপরাধ/দুর্ঘটনা উদঘাটন বা প্রতিরোধে সহযোগিতা করতে হবে। ভ্রমণের পূর্বে প্রত্যেক পর্যটকের পরিচয় সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যাদি একটি ফরমে (নাম, মোবাইল নম্বর, এনআইডি/জন্মনিবন্ধন ইণ্যাদি) সংগ্রহ করে স্থানীয় প্রশাসন/আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট জমা প্রদান করতে হবে। রাত্রিকালীন চলাচলের সময় নৌযানে নির্দেশিকা লাইট/আলোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। সুনামগঞ্জ বজ্রপাত প্রবণ এলাকা হওয়ায় বজ্রপাত ও বৃষ্টির সময় অবশ্যই পর্যটকদের অবস্থান নৌকা/ জলযানের ভিতরে নিশ্চিত করতে হবে। ভ্রমণকালে যেখানে সেখানে অবতরণ, বিচরণ ও অবস্থান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ভ্রমণকালে কোনো মাইক/মাইক্রোফোন জাতীয় উচ্চ শব্দযন্ত্র বহণ করা যাবে না। হাওরের নির্জনতা বজায় রাখতে সহায়তা করতে হবে। পর্যটকবাহী নৌকা চলাচলের জন্য নির্ধারিত রুট অনুসরণ করতে হবে। হাওরে ভ্রমণকালে মানববর্জ্যসহ অন্যান্য বর্জ্য কোনোভাবেই হাওরের পানিতে ফেলা যাবে না। হাউস বোটে পর্যাপ্ত পরিমাণ সেফটিক ট্যাংক সরবরাহ রাখতে হবে। অভয়ারন্য হিসেবে স্বীকৃত এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণ এবং মাছের প্রজনন স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে স্বীকৃত/চিহ্নিত এলাকায় ইঞ্জিন চালিত নৌযান দিয়ে প্রবেশ করা যাবে না। তবে পর্যটকদের ভ্রমণের সুবিধার্থে ইঞ্জিন বিহীন/লোকাল নৌকায় নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ভ্রমণ করতে পারবে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় পর্যটক পরিবহন সম্পূর্ণরুপে বন্ধ রেখে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে হবে। সময়ে সময়ে কর্তৃপক্ষের জারীকৃত যে কোনো আদেশ, নির্দেশনাবলী প্রতিপালন করতে হবে। পর্যটন স্পটসমূহ সীমান্তবর্তী হওয়ায় পর্যটকবাহী হাউসবোট/নৌযান নিয়ে কোনোভাবেই সীমান্তের শূন্য লাইন অতিক্রম করা যাবে না।
পর্যটকদের প্রতি নির্দেশনাবলী: হাওরের প্রবেশপথে বা অবস্থান ভ্রমণকালে প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কর্তৃক নৌযান পরিদর্শনকালে পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে। হাওরে প্রবেশ করার পর জলে, স্থলে কোনভাবেই কোন আবর্জনা ফেলা যাবে না। কেবলমাত্র নির্ধারিত স্থানে আবর্জনা ফেলতে হবে। ট্যাকেরঘাট ব্যতীত নৌকা/ জলযানে অন্যকোথাও রাত্রিযাপন করার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে পূর্বে অবহিত করতে হবে। শিক্ষাসফরের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। প্রতি গ্রুপে প্রয়োজনীয় সংখ্যক অভিভাবক/শিক্ষক থাকতে হবে। নির্দিষ্ট স্থান ব্যতীত যত্রতত্র হাওর, নদী বা খালের পানিতে অবতরণ না করা এবং গোসল করা ও সাঁতার কাটা থেকে বিরত থাকতে হবে। হাওরের জীববৈচিত্র্য সংকটাপন্ন হতে পারে কিংবা জীববৈচিত্রের জন্য হুমকির সৃষ্টি হতে পারে এমন কোন কর্মকান্ড বা আচার-আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে। সুনামগঞ্জ বজ্রপাত প্রবণ এলাকা হওয়ায় বজ্রপাতের ও বৃষ্টির সময় নৌকা/জলযানের ভিতরে অবস্থান করতে হবে। যেকোন প্রকার অসামাজিক কর্মকান্ড/ইভটিজিং/মাদক গ্রহনসহ বেআইনি কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। স্থানীয় জনগণের সাথে কোনো ধরণের বিবাদে লিপ্ত হওয়া যাবে না। স্থানীয় মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। যেকোনো ধরণের প্রতারণা বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। নিজেদের মূল্যবান মালামাল নিজ দায়িত্বে রাখতে হবে। সীমান্তবর্তী পর্যটন স্পটসমূহে পর্যকটগণ কোনোভাবেই সীমান্তের শূন্য লাইন অতিক্রম করতে পারবে না। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে প্রবাহিত ঝরনা থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ পানি, অগণিত পাখির কলতান আর হিজল-করচ বনের অপরূপ সৌন্দর্যের সমাহার দেখা যাবে শুধু টাঙ্গুয়ার হাওরেই। বর্ষা ও শীত এই দুই মৌসুমে দুই রকমের সৌন্দর্যে অপরূপ হয়ে ওঠে এই হাওর। তবে পর্যটকদের মতে, এই হাওর তার আসল সৌন্দর্যে সাজে বর্ষাকালে।
সুরমা, যাদুকাটা, বৌলাই, পাটলাই ও ঘাসী নদী দ্বারা বেষ্টিত তাহিরপুর, মধ্যনগর ও ধর্মপাশা উপজেলায় ছোট বড় ১০৯ টি বিল ও ১২৬৫৫.১৪ হেক্টর ভূমি নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান। ১৯৯৯ সালে সরকার ওই হাওর এলাকাকে ‘বিপন্ন প্রতিবেশ এলাকা’ ঘোষণা করে। টাঙ্গুয়ার হাওরকে ২০০০ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ১০৩১ নম্বর রামসার এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কেবল সুনামগঞ্জ নয় গোটা বিশ্বে এটি বিরল প্রজাতির মৎস্য ও অতিথি পাখির স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত। এ হাওরে রয়েছে প্রায় ১৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৪ প্রজাতির দেশি মৎস্য ও বন্য প্রাণির বিপুল সমাহার। ৭ প্রজাতির জলাভূমির উদ্ভিদ, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণি, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি, ২১ প্রজাতির সাপ দেখা যায়।