টাঙুয়ার হাওরে দুয়ারী ফাঁদ দিয়ে মাছ ধরার প্রস্তুতি

তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি :
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ আগস্ট ২০২৩, ১:৪০ অপরাহ্ণ
এক সময় দেশব্যাপী মাছের রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিলো সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা। কিন্তু বিগত কয়েক বছর যাবৎ এই উপজেলাতেই মাছের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক প্রজাতির মাছ। এলাকার বাজারগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে না দেশীয় মাছ। চাষের পাঙ্গাস মাছে সয়লাব এলাকার প্রতিটি হাট-বাজার।
‘মৎস্য, পাথর, ধান, সুনামগঞ্জের প্রাণ’ প্রবাদে থাকলেও বর্তমানে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র পরিলক্ষিত হয়। এক সময় দেশীয় প্রজাতির মিঠা পানির মাছে ভরপুর থাকলেও বর্তমানে ধ্বংসের একেবারে দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে হাওর এলাকার মৎস্য ভান্ডার। শ্যালো মেশিন দিয়ে বিলের তলা শুকিয়ে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে মাছ শিকার, কারেন্ট জাল, কিরন মালা চাই, চায়না দুয়ারী ফাঁদ দিয়ে মাছ শিকার করায় নির্বংশ হয়ে যাচ্ছে শতাধিক প্রজাতির মিঠাপানির মাছ।
সংশ্লিষ্টদের কাছে জানা গেছে, এক সময় টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌকায় চলার সময় পানির নিচে নলখাগড়া আর বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ স্পষ্ট দেখা যেত। যার ফাঁকে ফাঁকে নৌকার গতির সঙ্গে সাঁতরে পাল্লা দিতো নানা ধরনের মাছ। এখন মাছের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্তির পথে জলজ উদ্ভিদ। আগে টাঙ্গুয়ার হাওরে বিরল প্রজাতির ফিস পেলিসাস ঈগল দেখতে পাওয়া গেলেও এখন আর তা চোখে পড়ে না।
হাওর পাড়ের জেলে শেরাফুল মিয়া বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে আগে নৌকা থেকে পানির নিচে মাছ দেখা যেত। মাছ নৌকায় লাফিয়ে উঠত। কিন্তু এখন জাল দিয়েও মাছ পাওয়া যায় না।
ছোট বড় ১০৯টি বিল ও ১২৬৫৫.১৪ হেক্টর ভূমি নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান। এ হাওরে ভরপুর বিপুল প্রান প্রকৃতির। হাওরে পানির নিচে উদ্ভিদ প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছের বাসস্থান এবং খাদ্যের জোগান দেয়। কিন্তু টাঙ্গুয়ার হাওর বর্তমানে পরিবেশ সংকটে পড়েছে। কর্তৃপক্ষের সঠিক নজরদারীর অভাবে অবাধে কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাণ হিজল-করচের বাগান। উচ্চ শব্দের মাইক আর নৌকা নিয়ে পর্যটকদের অনিয়ন্ত্রিত বিচরণে হাওর হারাচ্ছে তার নিজস্ব জৌলুশ। পর্যটকদের ফেলে যাওয়া ময়লা আর প্লাষ্টিকে সয়লাব টাঙ্গুয়ার হাওরের চারপাশ। হাওরের এমন দুর্দশায় ক্ষোভ জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন ও হাওর নেতারা। প্রাকৃতিক সম্পদ আর সৌন্দর্যে ভরপুর টাঙ্গুয়ার হাওরকে বৈশ্বিক গুরুত্বের কারণে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রামসার সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মাদার ফিশারিজ খ্যাত এই হাওর মাছের অভয়ারণ্য হিসেবে সংরক্ষিত। প্রতি বছর উৎপাদন হয় লাখ লাখ টন মাছ। তবে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।
সম্প্রতি টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুপ্রভাত চাকমা ও সহকারী কমিশনার ভূমি আসাদুজ্জামান রনি। এ সময় নিষিদ্ধ জাল জব্দ করে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এরপরও থেমে নেই এই জালের বিস্তার। হাওরে অবাধে বিচরন করছের এসব জাল নিয়ে জেলেরা। টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের বাসিন্দা খাইরুল ইসলাম জানান, কিরন মালা কারেন্টের জাল বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও এই জাল দামে সস্তা, ওজনে হাল্কা ও দ্রুত মাছ ধরায় জেলেদের এটি খুবই পছন্দ। তবে হাওরে মাছ শিকারের জন্য চায়না দুয়ারী জালের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে, যা কারেন্ট জালের মতই নিষিদ্ধ। এই জালের বিশেষত্ব হলো এটি নিখুতভাবে মাছ ধরতে সক্ষম। এই জালের ঘনবুনন, যে কারণে মাছ ঢুকলে বের হতে পারে না। পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, হাওর এলাকায় চায়না দুয়ারী জালসহ মৎস্য সম্পদের জন্য ক্ষতিকর মাছ ধরার চাই ও জাল ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। এছাড়াও মৎস্য আইন গুরুত্ব সহকারে প্রয়োগ করতে না পারলে মিঠা পানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাবে এবং হাওরের নানা জলজ প্রাণী ও জীববৈচিত্র হুমকিতে পড়বে। এই জালের বহুল ব্যবহার মৎস্যসম্পদের জন্য ক্ষতিকর।
সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামছুল করিম জানান, বর্ষাকালে পানিতে মাছ যখন প্রজননের জন্য ছড়িয়ে পড়ে তখন এই জালে ডিমওয়ালা মাছসহ নির্বিচারে সব বয়সের মাছ আটকা পড়ে। এই জালের ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকায় গোপনে জেলেরা এটি দিয়ে মাছ মারছে। এই জাল বিক্রয় ও ব্যবহারকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী জানান, যে বা যারা পরিবেশ, জলজপ্রাণী ও মাছের জন্য ক্ষতিকর জাল বিক্রি করবে ও ব্যবহার করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলার বিভিন্ন হাওরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অনেক জাল জব্দ করে পোড়ানো হয়েছে, মৎস্য সম্পদ রক্ষায় অভিযান অব্যাহত থাকবে।