আইনের শাসন বনাম ধনিকতন্ত্র

শেখ ফয়সল আমীন <<
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৬ অপরাহ্ণ
ভারসাম্যপূর্ণ একটি বিশ্বব্যবস্থার স্বপ্ন ও সাধনা দীর্ঘদিনের। কল্যাণ-বিশ্বের প্রত্যাশাও আধুনিক যুগলগ্নের। সে জন্য কালের প্রবাহে নানা ধরনের রাষ্ট্র, অর্থ ও সমাজদর্শনের উদ্ভব ও উন্মেষ। আমরা সেগুলোকে গণতন্ত্র (Democracy), সমাজতন্ত্র (Socialism), রাজতন্ত্র (Monarchy), সাম্যবাদসহ (Communism) আরো নানা নামে চিনি ও জানি। তবে সব রাষ্ট্রতন্ত্রেরই এক ও অভিন্ন লক্ষ্য ছিল বা আছে; সেটা হলো- বিশ্বব্যবস্থায় সর্বজনীন ও প্রমিত বা মান শাসনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করা। কিন্তু সেটা হয়নি। একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের জনপ্রিয়তা ও জয়জয়কার ছিল; বর্তমানে গণতন্ত্রের জয়যাত্রা চলছে। তবে যে কোনো শাসনতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকা বোধ করি কয়েকটি বিষয়ের ওপরে নির্ভর করে; আইনের শাসন সেসবের মধ্যে প্রণিধানযোগ্য। কারণ আইনের শাসন সর্বস্তরে সুশাসন ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে থাকে।
গণতান্ত্রিক এই বিশ্বব্যবস্থায় আইনের শাসন একটি ঢ়ড়ংঃবৎ পড়হপবঢ়ঃ. সুতরাং এখানে সব ক্রিয়াকলাপ পরিচালিত হওয়া উচিত আইনের অধীনে এবং আইনের স্থান থাকা উচিত সবকিছু এবং সবার ঊর্ধ্বে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নোবেলজয়ী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের ১৬০ ব্যক্তির একটি খোলা চিঠি প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সিজিয়ন পিআর নিউজওয়্যারের ওয়েবসাইটে; যে প্রতিষ্ঠানটি পেশাগতভাবে নানা ধরনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠানোর কাজ করে থাকে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা উদ্বিগ্ন যে সম্প্রতি তাকে (ড. ইউনূস) লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে এবং এটি ধারাবাহিকভাবে বিচারিক হেনস্তা বলে আমরা বিশ্বাস করি।’ যদিও বিবৃতির ভাষ্য ও বিষয়বস্তু তথ্য ও বস্তুনিষ্ঠ নয় বরং বায়বীয় ধারণাপ্রসূত; তবুও বিশ্বনেতাদের এমন বক্তব্য অনেক প্রশ্ন ও শঙ্কার জন্ম দেয়। যেমন- ক) নোবেল পুরস্কার কি এমন কোনো আন্তর্জাতিক আইনি সুরক্ষা দান করে, যার বলে পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ আইন ও বিচারের ঊর্ধ্বে উঠে যায়? খ) তাহলে কি ক্ষমতার কাছে প্রান্তিক শ্রমিকদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার একটি গৌণ বিষয়? গ) জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা কি দিন দিন কার্যকারিতা হারাতে বসেছে? ঘ) একটি দেশের বিচারাধীন বিষয়ে শিষ্টাচারবহির্ভূতভাবে প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা কতটুকু জ্ঞানপ্রসূত?
অথচ জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা (Universal Declaration of Human Rights) আর্টিকেল ৭ [Right to equality before the law] বলছে-The law is the same for everyone and should be applied in the same manner to all. এই ঘোষণার আর্টিকেল ৮ [Access to justice] বলছে—You have the right to obtain legal help and access the justice system when your rights are not respected. পাশাপাশি আর্টিকেল ১০ [Right to a fair trial]-এ বলা হচ্ছে-Trials should be public and tried in a fair manner by an impartial and independent tribunal. প্রশ্ন হচ্ছে- জাতিসংঘের এই ঘোষণার মধ্যে কি খেটে-খাওয়া শ্রমিকদের অধিকারের কথা নেই? ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার ন্যায়বিচার প্রাপ্তির প্রতিশ্রæতি কি এখানে নেই? তাছাড়া এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ন্যায্যতা নিশ্চিতে বিশ্ব নেতাদেরও কি কোনো দায় নেই; তাদের বিবেক এবং বোধ কি নিপীড়িত, নির্যাতিত, বঞ্চিত ও প্রান্তিক মানুষের জন্য জাগে না?
প্রসঙ্গক্রমে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের নোবেল পুরস্কারজয়ী প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সংক্রান্ত একটি সাম্প্রতিক ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়- অমর্ত্য সেনের পৈতৃক ১ দশমিক ৩৮ একর জমির মধ্যে ১৩ শতাংশ অবৈধ দখলের অভিযোগ করে আসছে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এ নিয়ে বীরভূমের মহকুমা আদালত ৬ মে ২০২৩ তারিখের মধ্যে অমর্ত্য সেনকে ওই জমি দখলমুক্ত করার নির্দেশ দেন। অমর্ত্য সেন দাবি করে আসছেন, ১৯৪৩ সালে তার বাবা আশুতোষ সেনকে ১ দশমিক ৩৮ একর জমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইজারা দিয়েছিল। সেই জমি এখন অমর্ত্য সেনের নামে বীরভূমের বোলপুরের ভূমি দপ্তর থেকে মিউটেশনও (নামজারি) করা হয়েছে। সুতরাং অবৈধ দখলের প্রশ্ন নেই। এমন পরিস্থিতিতে তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বিভাস রঞ্জন দে ৪ মে ২০২৩ তারিখে অমর্ত্য সেনকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের আদেশ সাময়িকভাবে স্থগিত করেছেন। ফলে মামলার নিষ্পত্তি বা চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে বা তাকে জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারবে না বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ বিচারকার্য চলবে; বিচারের রায় দুই পক্ষই মেনে নেবে।
অমর্ত্য সেন দেশের সংবিধান ও আইনব্যবস্থার ওপরে আস্থা রেখেছেন; তিনি এ বিষয়ে বিদেশি কোনো হস্তক্ষেপ আহ্বান করেননি বা বিদেশে গিয়ে দেশের ওপরে চাপ সৃষ্টি করাননি; আবার বিশ্ব নেতারাও স্বপ্রণোদিত হয়ে ভারত সরকারের কাছে খোলা চিঠি লেখেনি। এটি দেশের আইন, সংবিধান ও সার্বভৌমত্বের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধার একটি সুন্দর উদাহরণ, যা অমর্ত্য সেন স্থাপন করেছেন। পক্ষান্তরে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন অনুযায়ী কোম্পানির লভ্যাংশের পাঁচ শতাংশ টাকা প্রাপ্তির জন্য দায়েরকৃত সাধারণ শ্রমিকদের মামলা বন্ধে বিদেশিদের চিঠি, চাপ, বিবৃতি এবং আদালতের বিনা অনুমতিতে দেশ ছেড়ে বিদেশে বসে ড. ইউনূসের নানামুখী তৎপরতা একটি স্বাধীন দেশের আইন, সংবিধান ও সার্বভৌমত্বের প্রতি তীব্র অশ্রদ্ধার শামিল। পাশাপাশি এমন কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যবস্থায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সমন্বিত সংগ্রামপথে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি করবে। এটি এক ধরনের আচরণ যা ধনিকতন্ত্রের সঙ্গে মেলে। বস্তুত শাসনকাঠামোর বাইরে থেকেও ধনবান শ্রেণি তাদের অগাধ অর্থশক্তি ও শ্রেণিশক্তি ব্যবহার করে বিশ্ব শাসনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু জনসমর্থন ও জনসম্পৃক্ততা ব্যতিরেকে সে প্রচেষ্টা অরণ্যেরোদন ছাড়া কিছুই নয় বলে মনে হয়।
বিষয়টি সহজে বোধগম্য যে- ড. ইউনূস বনাম কতিপয় ভুক্তভোগী শ্রমিকের দেনা-পাওনা সংক্রান্ত মামলাটি এখন শুধু আদালত প্রাঙ্গণে সীমাবদ্ধ নেই; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটিকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দেশটি আধিপত্য সৃষ্টি করার স্বপ্ন দেখে। এ কথা সর্বজ্ঞাত যে- বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিরাগ আমাদের মুক্তিযুদ্ধপূর্বকাল থেকেই, কারণ এ দেশে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বারবার ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের বিজয় ও বিকাশে মার্কিন আধিপত্যের পরাজয়-ধ্বনিই শোনা গেছে বারবার। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্মকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের পররাষ্ট্রনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে মূল্যায়ন করে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি- ঊহপুপষড়ঢ়বফরধ ইৎরঃধহহরপধ-তে ঝবপৎবঃ ঝবৎারপব ঈড়ফব ঘধসবং ড়ভ ১১ ট.ঝ. চৎবংরফবহঃং শীর্ষক একটি নিবন্ধ আছে। সেখান থেকে জানা যায় যে রিচার্ড নিক্সনের কোড নেইম ছিল ‘সার্চলাইট’, যিনি মুক্তিযুদ্ধকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং পশ্চিম পাকিস্তানের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা ছিলেন। এখন গভীরভাবে অনুসন্ধান ও গবেষণার সময় এসেছে- ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে সংঘটিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর পেছনে রিচার্ড নিক্সনের ইন্ধন বা সমর্থন ছিল কি না দেখা।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া প্রসঙ্গে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী ও তাদের বলয়ের যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও তৎপরতা তা পর্যবেক্ষণ করলে কিছু বিষয় সামনে আসে। প্রথমত, এ অঞ্চলে উগ্র মৌলবাদী শক্তির প্রতি পশ্চিমা সমর্থন একটি বড় শঙ্কার জায়গা তৈরি করছে। দ্বিতীয়ত, ধনিকতন্ত্রের সঙ্গে মৌলবাদী অর্থনীতির একটি মিথস্ক্রিয়া ঘটছে; যা জঙ্গিবাদ ও আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদকে উসকে দিচ্ছে। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিতে ব্যক্তির অপরাধে পরিবারের ওপরে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের যে প্রকাশ্য ঘোষণা এসেছে তা ৎরমযঃ ঃড় লঁংঃরপব ড়ভ ধহ রহফরারফঁধষ-কে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে। চতুর্থত, ভারত ও চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তিমত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বঙ্গোপসাগর, সেন্টমার্টিনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূ-কৌশলগত স্থানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অভিসন্ধি দেখা যাচ্ছে; ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা বিনির্মাণের পথে এটি একটি বড় অন্তরায়। পঞ্চমত, আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে মার্কিন আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার তীব্র প্রচেষ্টা চলছে; যা প্রতিটি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য মহা-হুমকি। এসবের জন্য বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন পশ্চিমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ; সে লক্ষ্যে তারা নানামাত্রিক তৎপরতা চালাচ্ছে, প্রতিটা বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। অথচ তাদের দেশে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে। বিরোধী মতামতকে দমন করার জন্য সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বারবার গ্রেপ্তার করা হচ্ছে; মানবাধিকার ও জীবনাধিকার পিষ্ট হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বুটের তলায়।
উল্লেখ্য, অতিসম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াহিও শহরে পুলিশ কর্মকর্তার গুলিতে টাকিয়া ইয়াং (২১) নামে এক অন্তঃসত্ত্বা কৃষ্ণাঙ্গ নারী গর্ভের সন্তানসহ নিহত হয়েছে। এটি নিছক হত্যাকাণ্ড নয়, এটি কৃষ্ণাঙ্গদের ওপরে শ্বেতাঙ্গদের দীর্ঘকালীন নিধনযজ্ঞের ধারাবাহিকতা; এটি একটি বঃযহরপ ধহহরযরষধঃরড়হ ঢ়ৎড়পবংং. এটি সেই প্রাগৈতিহাসিক বর্ণবিরোধের নবতর নৃশংসতা, যে বর্ণবাদ ও বর্ণবিবাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন মার্টিন লুথার কিং। জানি না- সেই ১৬০ জন বিশ্বনেতা এ বিষয়ে ব্যথিত হবেন কি না, প্রতিবাদ বা নিন্দা জানাবেন কি না; তবে এ ঘটনায় আমরা মর্মাহত, আমরা প্রতিবাদ জানাই, বিচার চাই- ন্যায়বিচার। পাশাপাশি প্রত্যাশা করি ধনিকতন্ত্রের কশাঘাত থেকে সুরক্ষিত থাকুক বৈশ্বিক আইনের শাসন ও সার্বভৌমত্ব।
শেখ ফয়সল আমীন : কলাম লেখক ও বিশ্লেষক।
[email protected]