হবিগঞ্জে ধবংসের পথে দত্ত বাড়ীর ইতিহাস

বাংলানিউজ এনওয়াই ডেস্ক :
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ অক্টোবর ২০২৩, ২:৪০ অপরাহ্ণ
লাখাই ঐতিহাসিক দত্ত বংশের বাড়ী। বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানার স্বজনগ্রাম ( টাউনশীপ) ছিল দত্ত বংশের বসতি। লাখাই দত্ত বংশ ছিল চক্রপানি দত্তের বংশধর। বৃটিশ আমলে লাখাই দত্ত বংশ পশ্চিমবাংলা,পুর্ব বাংলা এবং আসামের আলোকিত ও শিক্ষিত বংশ ছিল। এই দত্ত বংশে সেই সময়ে ১২০ জন ছিলেন উচ্চ পর্যায়ের অফিসার। জনশ্রুতি রয়েছে, বৃটিশ আমলে শিলং,গৌহাটি,সিলেট থেকে কর্মকর্তারা লাখাই থানায় ভিজিট করতে এলে দত্ত বাড়ীর সামনে এসে গাড়ী থেকে নেমে হেঁটে লাখাই থানায় যেতেন।
লাখাই দত্ত বংশের লোকেরা সিলেট,শিলচর,শিলং,কলকাতা,দিল্লী,লন্ডন,নিউইয়র্কে বসবাস করতেন এবং চাকুরী করতেন। একমাত্র দুর্গাপুজার সময় হলে সবাই লাখাই বাড়ীতে আসতেন। লাখাই দত্ত বংশের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত আইনজীবী এবং পন্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের বন্ধু এডভোকেট রামকুমার দত্ত,কলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত আইনজীবী এডভোকেট অবিনাশ চন্দ্র দত্ত,ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী পত্রিকার সম্পাদক এডভোকেট নগেন্দ্র নাথ দত্ত, ১৯২৬ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় আইন সভার নির্বাচিত সদস্য শ্রীশ চন্দ্র দত্ত, লাখাই থানার প্রতিষ্টাতা রায়বাহাদুর এডভোকেট সতীশ চন্দ্র দত্ত যিনি ১৯৩০ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন এবং কিছুদিন ভারতবর্ষের স্পীকারের দায়িত্ব পালন করেন। রায়বাহাদুর হেমচন্দ্র দত্ত ১৯৩৭ এবং ১৯৪০ সালে আসাম পার্লামেন্টের মেম্বার নির্বাচিত হন। জ্যোস্না রানী দত্ত একবার আসাম পার্লামেন্টের মেম্বার এবং তিনবার ভারতের পার্লামেন্টের মেম্বার নির্বাচিত হন,কংগ্রেসের রাজনীতিবিদ এডভোকেট ধর্মদাস দত্ত,কংগ্রেস নেতা হরিপদ দত্ত, বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের প্রফেসর ডঃ ভবতোষ দত্ত,ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কমরেড বারীন দত্ত, ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নারী নেত্রী হেনা দাশ,ভাষা সৈনিক প্রশান্ত দত্ত,কৃষক নেতা ত্রৈলক্য দত্ত,স্বদেশী আন্দোলনের নেতা সুরেন্দ্রমোহন দত্ত, হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক সত্যব্রত দত্ত,চলচ্চিত্র পরিচালক মন্ময়নাথ দত্ত,ঢাকা জগন্নাথ কলেজের প্রফেসর হেমেন্দ্র কিশোর দত্ত, প্রফেসর ডঃ দিগিন্দ্র চন্দ্র দত্ত,শিলচর গুরুচরন কলেজের প্রিন্সিপাল রথীন্দ্র চন্দ্র দত্ত,কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যাপক সমরেন্দ্র দত্ত, প্রফেসর মৈত্রেয়ী দত্ত,অধ্যক্ষ সুধীন্দ্র চন্দ্র দত্ত, প্রফেসর ডঃ চিত্ততোষ দত্ত, প্রফেসর দেবশ্রী দত্ত,অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ডঃ অসীম কুমার দত্ত,প্রফেসর ডঃ পুর্ণেন্দু দত্ত,আমেরিকার পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডঃ রনজিত কুমার দত্ত,ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট প্রকাশ চন্দ্র দত্ত,শিক্ষাবিদ যোগেশ চন্দ্র দত্ত, একাউন্ট জেনারেল বীরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত,বিখ্যাত মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মনীন্দ্র চন্দ্র দত্ত,ইঞ্জিনিয়ার হীরেন্দ্রনাথ দত্ত,ইঞ্জিনিয়ার বীরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত, যুগ্ম সচিব বীরেশ চন্দ্র দত্ত,আইন সচিব নির্মল চন্দ্র দত্ত,কর্ণেল অশোক কুমার দত্ত,সিলেট বিভাগের প্রথম FRCS ডাক্তার ডাঃ পরেশ চন্দ্র দত্ত, হবিগঞ্জ জেলার প্রথম আইসিএস অফিসার ও ভারতের কেন্দ্রীয় সচিব শিশির কুমার দত্ত,ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় কাস্টম বোর্ডের চেয়ারম্যান জ্যোর্তিময় দত্ত অমল,বিশিষ্ট চা ব্যবসায়ী সুবোধ চন্দ্র দত্ত,ডাঃ নরেশ চন্দ্র দত্ত,ডাঃ কালীপদ দত্ত,ইঞ্জিনিয়ার বীরেশ চন্দ্র দত্ত,হবিগঞ্জ বারের বিখ্যাত আইনজীবী এডভোকেট সুরেশ চন্দ্র দত্ত,শিলচর বারের বিখ্যাত আইনজীবী এডভোকেট মহেশ চন্দ্র দত্ত,পুলিশ সুপার সুধীর চন্দ্র দত্ত, পুলিশের ডিআইজি দেবী দত্ত,ক্রিকেটার পুন্যব্রত দত্ত,বিজ্ঞানী ডঃ রনজিত কান্তি দত্ত,ব্যারিষ্টার অসীম কুমার দত্ত,ব্রাক্ষধর্মের অনুসারী শ্রীনাথ দত্ত, হবিগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান এডভোকেট অখিল চন্দ্র দত্ত,ডাঃ অলকানন্দা রানী দত্ত, ডাঃ আনন্দিতা রানী দত্ত,ক্যাপ্টেন ডাঃ অমল কুমার দত্ত,নাসা বিজ্ঞানী দেবাশীষ দত্ত,সমাজসেবক দ্বীপ চন্দ্র দত্ত,এডভোকেট নীরেন্দু কুমার দত্ত,সিলেট বারের বিখ্যাত আইনজীবী চারু চন্দ্র দত্ত,শিলচর বারের নামজাদা উকিল সুরেশ চন্দ্র দত্ত,এডভোকেট ইন্দ্র কুমার দত্ত,ব্যারিষ্টার রাজকুমার দত্ত,কমরেড দেবব্রত দত্ত, ব্যারিষ্টার প্রফুল্ল কুমার দত্ত,সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ধীরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত,এডভোকেট নবকুমার দত্ত,ডাঃ সুবীর কুমার দত্ত, জেলা জজ নলিনী কুমার দত্ত, ঢাকাস্থ ভারতের সাবেক ডেপুটি হাইকমিশনার মুক্তা দত্তের দাদু সমাজসেবক ও শিক্ষাবিদ শৈলেন্দ্রমোহন দত্ত,জেলসুপার রামেন্দ্র কুমার দত্ত, ত্রিপুরা সরকারের শিক্ষা দপ্তরের
খ্যাতনামা অফিসার কৃষ্ণপদ দত্ত বা কেপি দত্ত,ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা গবেষনা ও উন্নয়ন সংস্থার প্রিমিয়ার ইন্সট্রুমেন্টেশন ল্যাবের গ্রেড-১ সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ক্ষিতিপদ দত্ত, হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক নগেন্দ্র চন্দ্র দত্ত,পুলিশের গুলিতে নিহত নক্সালপন্থী নেতা শহীদ ইঞ্জিনিয়ার সুব্রত দত্ত।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান সৃষ্টি হলে লাখাই দত্ত বংশের লোকেরা নিজ জন্মভুমি ত্যাগ করতে থাকেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সামরিক আইন জারী করলে লাখাই দত্ত বংশের লোকেরা একেবারে শুন্য হয়ে যায়। কমরেড বারীন দত্ত ও নারী নেত্রী হেনা দাশ দুই ভাইবোন ঢাকায় অবস্থান করে কমিউনিষ্ট পার্টির রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়েন।
১৯৬০ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান ” টাউনশীপ” প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে লাখাই ঐতিহাসিক দত্ত বাড়ীতে লাখাই থানা পরিষদের কার্যক্রম এই বাড়ী থেকে শুরু হয়। যার কারনে লাখাই ঐতিহাসিক দত্ত বাড়ীর নাম হয় ” টাউনশীপ”।
১৯৮৩ সালের ১৫ এপ্রিল লাখাই থানার সদর দপ্তর বামৈ ইউনিয়নের কালাউকে স্থানান্তরিত করা হলে দত্ত বাড়ীর দালানগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। দত্ত বাড়ীর লাল বিল্ডিং,দুটো সাদা বিল্ডিং,টিনশেডের দুতলা একটি বিল্ডিং যেখানে সাবরেজিষ্টার অফিস ছিল,কাছাড়ী ঘর,জাতীয় বিদ্যালয়,লাইবেরী,ডাক বাংলা,একটি দুর্গা মন্দির ছিল। সবই আছে তবে জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে।
এই লাল বিল্ডিংতে থাকতেন রায়বাহাদুর এডভোকেট সতীশ চন্দ্র দত্ত। এরপর থাকতেন সমাজসেবক দ্বীপ চন্দ্র দত্ত ও তার পরিবারের লোকজন। পরবর্তীতে লাখাই সার্কেল অফিসার ( সি ও) এর বাসভবন ছিল।
লাখাই দত্ত বাড়ীতে লাখাই ১ নং ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়,লাখাই ১ নং ইউনিয়ন ভুমি অফিস, লাখাই হাজী করিম হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা,এতিমখানা,মসজিদ,দোকান, মার্কেট, বাড়ীঘর প্রতিষ্টিত হয়েছে।
নেই ঐতিহাসিক দত্ত বংশের কোন স্মৃতি। সব স্মৃতি মুছে ফেলা হয়েছে।
ঐতিহাসিক দত্তবাড়ীর লোকেরা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন,স্বদেশী আন্দোলন,ভাষা আন্দোলন,১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা রাখেন। দত্ত বাড়ীর ইতিহাস আজ ধবংসের পথে।
এই দালানগুলো লাখাই উপজেলা প্রশাসনের দখলে আছে। লাখাই উপজেলা প্রশাসন নিজে উদ্যোগী হয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে এই লাল বিল্ডিং এ “লাখাই ঐতিহাসিক দত্ত বংশের স্মৃতি বিজড়িত যাদুঘর” করতে পারে।