প্রস্তুতি সুলতানের,সিগন্যাল চান ইনাম,স্বপ্নীল ও ছহুল
নীরব চাকলাদার :
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ অক্টোবর ২০২৩, ১:৩১ পূর্বাহ্ণদ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। তপশীল ঘোষণা না হলেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে বিরোধী দলগুলোর অন্ত:নেই অভিযোগের। তা সত্বেও থেমে নেই আওয়ামী লীগ নেতাদের মনোনয়ন প্রাপ্তির লবিং-তদবির। প্রতিটি নির্বাচন আসলেই এ দলের মধ্যে শুরু হয় মনোয়ন প্রাপ্তির জোর লড়াই ও তদবির। কেউ হয়ে ওঠেন ‘বড় আপা’ কেউ বা আবার ‘ছোট আপা’র ‘মাইম্যান’! এমন অবস্থায় যেমন আওয়ামী লীগকে পড়তে হয় নানা জটিলতায়, তেমনি বিভ্রান্ত হতে হয় তৃণমূল নেতাকর্মীদের। এ নিয়ে শুরু হয়ে যায় দলের মধ্যে বিদ্রোহ। বিদ্রোহীদের থামাতে গিয়ে চলে আসে বহিষ্কারাদেশ।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসন বহুল প্রত্যাশিত ও আলোচিত। কারণ এ আসনে যে দলের প্রার্থী জয়লাভ করে, সে দলই প্রতিবার দেশের মসনদে যায় এবং সরকার গঠন করে। বহুল প্রচলিত এ কথা কতটুকু সত্যি, সেটি নির্বাচনের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এই গুরুত্ব পূর্ণ আসনে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ এই আসনটিতে আওয়ামী লীগের হয়ে এবার প্রার্থী হতে চান আরও অনেকে। এর মধ্যে আলোচনায় আছেন ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, ইনাম আহমদ চৌধুরী, সম্প্রীতির বাংলাদেশ এর সদস্য সচিব ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন।
সিলেট-১ আসনে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন আবদুল হেকিম চৌধুরী। এরপর নির্বাচিতরা হলেন রফিকুল হক, হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী, খন্দকার আবদুল মালিক, হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী, সাইফুর রহমান,আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং সর্বশেষ ড. আবদুল মোমেন।
সিলেট মহানগর ও সদর উপজেলা মিলে সিলেট-১ আসন। সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে অংশ নিবে বিএনপি। বিএনপি থেকে প্রস্তুত রয়েছেন একাধিক প্রার্থী। থেমে নেই আওয়ামী লীগও। শক্তিশালী এই আসনটি সকল দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ফলে প্রধান দুটি দলও চায় একজন গ্রহণযোগ্য শক্তিশালী প্রার্থী। এ আসনে গেলবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির রয়েছেন আলোচনায়। তবে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে সর্বশেষ নামটি হচ্ছে সিলেট সিটির বিদায়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
সিলেট-১ আসনে জয়ী আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী স্পিকার হয়েছিলেন। বিএনপির প্রয়াত নেতা এম সাইফুর রহমান ও আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন। সর্বশেষ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন সিলেট-১ আসনের এমপি এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি প্রয়াত অর্থমন্ত্রী মুহিতের ছোট ভাই।
আসন্ন সংসদ নির্বাচনে বর্তমান এমপি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এবারও নির্বাচন করবেন। দলের প্রার্থী তালিকায় আরও যাদের নাম রয়েছে তাঁরা হলেন, ডাকসুর সাবেক ভিপি আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এমপি সুলতান মনসুর, সিলেটের কৃতি সন্তান ইনাম আহমদ চৌধুরী, সম্প্রীতির বাংলাদেশ এর সদস্য সচিব ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন।
আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, গত ২ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের অভিষেক অনুষ্ঠানে সুলতান মনসুরের এক মঞ্চে উপস্থিতির পর থেকে সিলেটে তার প্রার্থিতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যদি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়, তখন শক্তিশালী প্রার্থিতার প্রসঙ্গে তার নামটি আসছে।
এ ব্যাপারে ইতিবাচক সম্মতি রয়েছে সুলতান মনসুরের। তিনি বলেন, বিষয়টি দলীয় প্রধানের ইখতিয়ার। দলীয় প্রধান সিলেট, মৌলভীবাজার অথবা ঢাকার যে আসনে আমাকে যোগ্য মনে করবেন, আমি সেখানেই লড়ে যাবো। নৌকা ছাড়া আর নির্বাচন করব না।
সুলতান মনসুর মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া) আসনের এমপি হলেও তার রাজনীতির বড় একটি সময় কেটেছে সিলেটে। সিলেটের এমসি কলেজ, মদনমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। সিলেট অঞ্চলের আওয়ামী লীগের রাজনীতির নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়ও ছিলেন। দুবার কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক থাকাকালে সিলেটের সাংগঠনিক দায়িত্বও পালন করেছেন। ১৯৯৬ সালে নৌকা নিয়ে মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে প্রথম নির্বাচিত হন। এরপর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে অভিষিক্ত হন। ওয়ান-ইলেভেনের পটপরিবর্তনে আওয়ামী লীগ থেকে বাদ পড়েন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে জয়ী হন।
এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হবার গুঞ্জন রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগের প্রধান ও সম্প্রীতি বাংলাদেশ এর সদস্য সচিব সিলেট শহরের ছড়ারপার এলাকার সন্তান, বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব স্বপ্নী্লের। তিনি ২০১৭ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কাজ করছেন সিলেটে। করোনাকাল থেকে শুরু করে গেল বন্যায় দুহাত উজাড় করে কাজ করেছেন মানুষের কল্যাণে। ৫ বছর কাজের সুযোগে সিলেটের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্চাসেবী সংস্থার বিভিন্ন কায়ক্রমে জড়িত রেখেছেন নিজেকে।
এ ব্যাপারে ডা. অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব স্বপ্নী্ল বলেন, জন্মস্থানের প্রতি দায়বোধ থেকেই কাজ করে যাচ্ছি মানুষের কল্যাণে। তাছাড়া সারাদেশে সরকারের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ তোলে ধরার চেষ্টা করছি। একই সাথে আওয়ামী লীগের কল্যাণ ধারার রাজনীতির সুফল তৃণমূলে পৌছে নিতে প্রানান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সিদ্বান্ত গ্রহণ করবেন। প্রধানমন্ত্রী কাজ পাগল মানুষ। তিনি যাকে এই কাজের উপযোগী মনে করবেন, তাকেই উপযুক্ত স্থানে নির্নয় করবেন।
সিলেটের অন্যতম প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান ইনাম আহমেদের প্রভাব রয়েছে স্থানীয় রাজনীতিতে। তার ভাই ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী ছিলেন সেনা নিয়ন্ত্রিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং ওই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ তাদের ভগ্নিপতি। ইনামের বড় ভাই প্রয়াত ফারুক আহমেদ চৌধুরী ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব।
সিলেট-১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী গত নির্বাচনের প্রার্থী খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। এ আসনে বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি খন্দকার আব্দুল মালিকের সন্তান মুক্তাদির ২০১৮ সালে প্রথম বিএনপি থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন। সিটি করপোরেশনের বিদায়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর মনোনয়ন প্রত্যাশায় দলটিতে স্পষ্টত বিভক্তি রয়েছে।
তবে নির্বাচন বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই বিএনপির। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বলছেন, ‘আমরা এখন সরকার পতনের আন্দোলনে আছি। তাই মনোনয়ন বা এ-সংক্রান্ত বিষয়ে কাজ করছি না। যদি আমাদের দাবি মেনে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ হয়, তাহলে গতবারের প্রার্থী হিসেবে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরই অগ্রাধিকার পাবেন।’ মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সদস্য পদ থেকে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হয়েছেন। ফলে মুক্তাদিরের ‘অগ্রাধিকার’ পাওয়ার বিষয়টি অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে বলে মনে করছেন স্থানীয় বিএনপির নেতারা। তারা জানান, আরিফ সিটি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। তবে কোন আসন থেকে তিনি প্রার্থী হবেন, এ নিয়ে এখনো দোলাচল কাটেনি।
সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে সিলেট-১ আসনে এবার প্রার্থী দিতে চায় জামায়াতে ইসলাম। এই দলের আলোচনায় রয়েছে জামায়াতের কেন্দ্রীয় আমির ডা. শফিকুর রহমানের নাম। দলের প্রার্থী তালিকায় নাম রয়েছে এহসানুল মাহবুব জুবায়েরের।
সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির ফখরুল ইসলাম জানান, সিলেটের ছয়টি আসনের মধ্যে চারটিতে জামায়াতের প্রার্থী তালিকা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী বাধা কাটিয়ে উঠতে পারলে দলীয় প্রার্থী দেওয়া হবে।’ এ ক্ষেত্রে সিলেট-১ আসনে প্রার্থী কে জানতে চাইলে ফখরুল বলেন, ‘২০১৮ সালে সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা এহসানুল মাহবুব জুবায়ের সিলেট-১ আসনে প্রার্থী হবেন। দলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আলোকে প্রার্থিতা অদলবদল হতে পারে।
জুবায়ের জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। ছাত্রশিবির ও জামায়াতের তরুণ নেতাদের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ২০১৮ সালে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে জামায়াত জুবায়েরকে মেয়র পদে প্রার্থী করেছিল। আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রার্থীর মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে ছিলেন জুবায়ের। অবশ্য দলের একটি সূত্র বলেছে, শেষমেশ কেন্দ্রীয় আমির সিলেট-১ আসনে প্রার্থী হতে পারেন।
সিলেট বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী বোর্ড দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বৈঠকে বসা হবে। সেখানে মনোনয়নের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তখন অফিশিয়ালি জানানো হবে। এর আগে মনোনয়নের ব্যাপারে বলা কথা তো কোনো সিদ্ধান্ত না। কে প্রার্থী, তা-ও নিশ্চিত না।’