‘আমি যখন আবাদি’

দিনা ফেরদৌসঃ
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ নভেম্বর ২০২৩, ১০:০১ অপরাহ্ণ
যখনই লোকজনদের রেসিস্ট বলে দোষারূপ করেছি, তখনই নিজেকে প্রশ্ন করেছি, আমি বর্ণবাদ মুক্ত কিনা। যাদের বর্ণবাদ মুক্ত মনে হয়েছে, তাদের মধ্যেও লক্ষ্য করেছি সব বিষয়ে না থাকলেও ছোট খাটো বিষয়ে তাদের মধ্যেও বর্ণবাদ বাসা করে আছে। পরিস্থিতি সামনে আসলে বেরিয়ে যায়, যার ব্যতিক্রম আমিও নই কিছু কিছু ক্ষেত্রে। যখনই বিষয়গুলি নিয়ে ভাবনা শুরু করি, তখনই আবিষ্কার করেছি যে, একজন ব্যক্তির পক্ষে নিজ থেকে রেসিস্ট বা বর্ণবাদী হওয়া কোনভাবেই সম্ভব না। এইসব আচরণ আমরা প্রথমত পরিবার, দ্বিতীয়ত আশপাশের পরিবেশ থেকে শিখি, অতঃপর সমাজের চারপাশের ছড়িয়ে দেই ।
আমার নিজের কথাই বলি। আমি একজন সিলেটি। শুধু সিলেটি বললে ভুল হবে, সিলেটি কুটি বললে যা বলতে চাচ্ছি তা পরিষ্কার হবে। ছোটবেলা থেকে যেমন জেনে আসছি দুনিয়ার এক নম্বর ধর্ম হচ্ছে ইসলাম, ঠিক তেমনি জেনে আসছি দুনিয়ার একনম্বর জাতি হচ্ছে “সিলেটি”। সিলেটের বাইরের জেলাগুলোর বাদবাকি সকলে “আবাদি”। কেউ আবার ’বেঙ্গলি’ও বলেন। সিলেটে কাজের সূত্রে অনেক জেলা থেকেই লোকজন আসেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বাসা ভাড়া করে ফ্ল্যাটে থাকেন, কেউ কেউ বস্তিতে। সিলেটে বস্তিকে বলা হয় কলোনি। যেমন ‘বোদাই মিয়ার কলোনি আবাদি ওখান ভরি গেছে’। মানে বস্তির মালিক হচ্ছেন বোদাই মিয়া, আর তার কলোনিতে (বস্তিতে) সবই হচ্ছে নন-সিলেটি বা আবাদি (মানে যারা সিলেটি না) । সিলেটের সবাই মনে মনে জমিদার। সবার দাদা পরদাদার জমিদারী গল্প আছে। কিন্তু পুরাতন জমিদার বাড়ির চিহ্ন খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
এক সময় মানুষ ছিল কম। জমিজমার দামও ছিল তুলনামূলক কম। কারো দাদা পরদাদায় হয়তো কিছু জমিজমা কিনে রেখেছিলেন। বংশ বৃদ্ধির সাথে সাথে ভাগ বাটোয়ারা করে সেই জমিতে যখন কপালের টিপ ফেলার জায়গা নেই, তখন সেই জমিদারী গল্প শুনতে যেমন লাগে আর কী!
তো সেই আবাদিদের সম্পর্কে বহু গল্পও চালু আছে সিলেটে। বিশেষ করে যারা ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকেন, ভালো চাকরি করেন তাদের নিয়ে। যেমন ননসিলেটিরা বিকেলে মুড়ি দিয়ে চা খেয়ে সন্ধ্যা পার করে। খাবার-দাবারে এরা খুব টাইট | সব ফ্যাশন উপরে উপরে| আর মুখে শুধু পণ্ডিতি। এটা অবশ্য আমার আলোচনার বিষয় না। কিন্তু বলছি এই কারণে যে, এই আমেরিকা দেশে আমি নিজেও এক আবাদি | আমরা যেখানে নিজের দেশের মানুষকে নিয়ে নানা ধরনের বর্ণবাদী চিন্তা করি, এখানে ভিন্ন দেশের মানুষকে এরা কিভাবে সহ্য করে ভেবে পাই না |
সেই ননসিলেটিদের মাতা আমি সিলেটিকেও হিসাব করে চলতে হয় এই ভিনদেশে। দাদার আমলে জমিদার এই জাতীয় গল্প দিয়ে জাতে উঠার কোনো চান্স নাই। মুখের উপর বলে দিতে পারে কেউ, দাদার জমিদারী ছেড়ে এখানে মরতে এসেছো কেন ? সব জায়গায় বুঝে শুনে চলতে হয়, কারণ এখানে আমি একজন আবাদি। সিলেটি বিলাসিতা দেখাবার সুযোগ এখানে নেই। ঠেকায় পড়লে এখানে কোনো গৌরী সেন নেই, যে টাকার ব্যবস্থা করে দেবেন। তাই আমাকেও মুড়ি খেতে হয় মাঝে মাঝে ।
আমার সিলেটি কুট্টিদের সমস্যা যে শুধু বাইরের জেলাগুলোর মুড়ি খাওয়া লোকজনদের নিয়ে তা কিন্তু নয়। সিলেট শহর বা বৃহত্তর সিলেটের মধ্যেও যারা আছেন, তাদের নিয়েও আগে রেসিস্ট ভাবনা। সিলেট শহরের একটু ভিতরে গোল আছে জৈন্তাপুর। ফৈরপুরের লোকজনদের জৈন্তাপুরী বললে তারা খুব মাইন্ড করে দে বলা হয় জৈন্তাপুরী ভূত। মানে এদের চলাফিরা আধুনিক সিলেটিদের মতো না (আমি বলতে চাচ্ছি না যে সিলেটিরা খুব আধুনিক, মনে মনে তারা নিজেদের একটু আলাদা ভাবেন, অন্য সবার থেকে সব সময়, তাই আমার এই বলা)। (যদিও জৈন্তাপুরী কোনো এক ভূতের সঙ্গে আমি এখন সংসার করছি)।
সিলেটের মাছিমপুরের দিকের লোকজনদের বংশ ভালো না, জাতে মাইমল ( মানে যারা জান ফেলে মাছ ধরে, সেই মাছ বিক্রি করে) এই জাতীয় কথাও প্রচলিত আছে। সিলেটের “কাষ্টঘর” এলাকা নিয়ে নাই বললাম, কোন সিলেটি এই লিখা পড়লে এমনিতেই বুঝতে পারবেন কী বলি নাই। এদিকে সিলেটের বিয়ানীবাজারের লোকজনদের নিয়েও আছে বদনাম। বলা হয়,” আল্লায় যদি বিয়ানীবাজারের লোকজনদের পয়দা করলেন, তবে শয়তান পয়দা করার দরকার কী ছিল” (মানে হচ্ছে বিয়ানীবাজারের লোকজন শয়তানের থেকেও অধম)।
বৃহত্তর সিলেটের মধ্যে আছে মৌলভীবাজার। মৌলভীবাজারের লোকজনদের নিয়েও গল্পের শেষ নাই। তারা নাকি একবার চেয়ারম্যান ইলেকশনে কোন এক মুচি’ কে দাঁড় করিয়ে পাস করিয়েছিল। সেই থেকে তাদের বলা হয় ” মনইবাজারী গা” ( মানে হচ্ছে মৌলবীবাজারের লোকজন আহাম্মক)। মৌলবীবাজারের লোকজন দেখলেই শমুকে সিলেটিদের মাথায় এই চিন্তাটা চলে আসে।
এইদিকে হচ্ছে ” সুনামগঞ্জ”, যা বৃহত্তর সিলেটেই মধ্যেই। সুনামগঞ্জের বেশিরভাগ এলাকা একটু নীচুতে। অল্প বৃষ্টি হলেই পানিয়ে চারপাশ ভরে উঠে। তাই বলা হয়। সুনামগঞ্জের লোক “পানিতে হাগডা” ( মানে হচ্ছে এরা পানিতে হসু করে) । যদিও সারা বছর এদের এলাকায় পানি থাকে না, কিন্তু সুনামগঞ্জীদের দেখলেই কথাটা আমাদের কুট্টিদের মাধার থোন।
এবার আমি “হবিগঞ্জে” এ। এবার ও বৃহত্তর সিলেটের মধ্যেই। উল্টো দিক থেকে আসলে প্রথমে কুমিল্লা, তারপর ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, অতঃপর হরিগর। তাই হবিগঞ্জের যোগাযোগ, ভাল ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার দিকে। আঞ্চলিক ভাষাটাও ব্রাহ্মণবাড়ীয়া আর কুমিল্লা ঘেঁষা। ফলে এরা আবাদিদের কাভাবেই পরে। এই হচ্ছে বৃহত্তর সিলেটের লোকজনদের নিয়ে সিলেটি ভাবনা |
এই সব ধরনের ভাবনাগুলোকে ছাপিয়ে গেছে বর্তমান সিলেটি ভাবনাগুলো। এখন সিলেটে তিন জাতের লোক বাস করে। এক. গরীব বংশের লোক, দুই. বড়লোক বংশের লোক, তিন, বিদেশি বংশের বা বাড়ির লোক (বিদেশ মানে সৌদি আরবী বা দুবাইওয়ানা না। লন্ডন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইতালি, সুইডেন, বিশেষ করে ইউরোপীয়ান কান্ট্রিগুলো)।
এবার আসি গরীব বংশের লোক বলতে কী বলতে চেয়েছি! যাদের দাদার জমিদারী গল্প ছাড়া এখন দেখাবার মতো কিছুই নেই। আছে পুরাতন একখান বাড়ি। আশপাশের বিদেশি বাড়ির বিল্ডিং এর ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখাও মুসকিল। যারা এখনও চলেন শক্ত হাড্ডির গল্প শুনাবে। যে কিছু না থাকলেও আমাদের “হাড়ি এখনো টন টন করে” এজাতীয় গল্প শুনিয়ে। যদিও বাজারে এইসব গল্প এখন অচল। সবাই জানে টাকা না থাকলে এই সব টন টনে গল্প কোন কাজে আসে না।
তবে বড়লোক বংশের বিষয়গুলো বেশ মজার। তারা আর দাদার জমিদারীর গল্প শুনায় না। কারণ তারা নিজেই এখন জমিদার । টাকা পয়সা বানিয়েছে। সুবিধামতো খান / চৌধুরীসহ টাইটেল নিজেরাই লাগিয়েছে। ছেলে-মেয়েদেরও উচ্চ শিক্ষা করাচ্ছে দেশে-বিদেশে। নিজেদের ব্যবসা বানিজ্যেরও উন্নতি ঘটিয়েছে, তাই তাদের বংশ নিয়ে কথা বলতে খবর আছে। এবার আসি সেই বিদেশি বংশের বা বাড়ির লোকজনদের কাছে। এদের কোন জাত, বংশ, গোত্র লাগে না। এদের জাত, বংশ, গোত্র একটাই এরা “বিদেশি”
বিশেষ করে বিয়ে শাদীর ক্ষত্রে এটার প্রভাব খুব বেশি লক্ষ্য করা যায়। বলতে চাইছি না এটা করা ভুল। কার অর্থনৈতিক চাকা কে কীভাবে ঘুরাবে তা সে নিজেই ভালো। জানে। বলতে চাচ্ছি, এই যে এতো জায়গার লোকজনদের নিয়ে আমরা এতো মাতামাতি করি, রেসিস্ট ভাবনাগুলো শোষণ করি, তার থেকে এখন বেরিয়ে আমার সময় হয়েছে | শুধু দেশের সুবিধাগুলো নেবো একে তাকে আবাদি ননসিলেটি বলে অবজ্ঞা করবো আর বিদেশে এসেও বিদেশিদের কাছ থেকে নিজের সুবিধা চাইবো, মানৱাধিকার আশা, করবো এমন হয় না। একটা পরিবর্তনের দরকার আছে এখনি। না হলে পরবর্তী সিলেটি জেনারেশন এই সমস্যায় ভূগবে।
কারণ বর্তমান জেনারেশন শুধু সিলেটের নাগরিক না, এরা বিশ্ব নাগরিক হতে চলেছে। এই ভাবনা গুলো থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে, বিশ্ব দরবারে গিয়ে হোঁচট খাবে প্রতিনিয়ত।
কপি : উইমেন চাপ্টার