শ্রমিকদের আন্দোলন যৌক্তিক

জয়দেব রায় >
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ৮:২৬ অপরাহ্ণ
একটি স্বনামধন্য পত্রিকার প্রতিবেদন পড়ছিলাম। প্রতিবেদন অনুযায়ী গত এক সপ্তাহে ৪০০ কারখানা বন্ধ হয়েছে এবং গত দশ মাসে বন্ধ হয়েছে ৩১২টি। তাহলে হিসাব করলে এটা বোঝা যাচ্ছে যে বর্তমানে গভীর সংকটে রয়েছে গার্মেন্টস। শ্রমিকদের আন্দোলনের জন্য শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের অর্থনীতির জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
শ্রমিকেরা যে কারণে আন্দোলন করছে তার অন্যতম কারণ হলো গত ২২ অক্টোবর মজুরি বোর্ডের সভায় শ্রমিকদের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরি দাবি করে প্রস্তাব দেন। কিন্তু মালিকপক্ষ বলে তারা ১০ হাজার ৪০০ টাকা দেবেন। তারপর থেকেই গাজীপুরে মজুরি নিয়ে শ্রমিকেরা আন্দোলনে নেমে পড়েন। আন্দোলনে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এবং অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের দাম হু-হু করে বাড়ছে। শ্রমিকদের দাবি কেন যথাযথ আমি একটা হিসাব করে দেখাতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও গবেষণা ইনস্টিটিউট হিসাব করে দেখিয়েছে, একজন পুরুষ গার্মেন্টস শ্রমিকের দৈনিক ৩ হাজার ৩৬৪ কিলোক্যালরি এবং নারী গার্মেন্টস শ্রমিকের দৈনিক ২ হাজার ৪০৬ কিলোক্যালরি শক্তি খরচ হয়। নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে কিলোক্যালরি কিছুটা কম হলেও সন্তান প্রসবের সময় আবার বেশি প্রয়োজন হয়।
পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, একজন শ্রমিকের তার খাবারের ৫৭ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার যেমন চাল, আটা থেকে, ৩০ শতাংশ চর্বি জাতীয় খাবার যেমন তেল, ঘি এবং তেরো শতাংশ প্রোটিন যেমন মাছ, মাংস, ডিম থেকে পূরণ করা উচিত। শরীরের জন্য ভিটামিনও খুবই প্রয়োজন। শ্রমিকের শরীরে যদি প্রয়োজনীয় কিলোক্যালরি না যায় সে কর্মক্ষম থাকতে পারবে না এবং অসুস্থ হয়ে পড়বে। শ্রমিকের প্রয়োজনীয় শক্তি ও পুষ্টি পূরণ করার জন্য যদি সে বাজারের নি¤œমানের খাবারও খায় তবুও তার যে খরচ লাগবে সে বেতন সে পায় না।
এখানে একজন শ্রমিকের দৈনিক মোট খরচ হচ্ছে ১৬৮ টাকা। খাদ্য দ্রব্যের দাম যেহেতু ওঠানামা করে সেহেতু আমি ধরে নিলাম একজন শ্রমিকের দৈনিক মোট খরচ হয় ১৪০ টাকা। একজন শ্রমিকের পরিবারে যদি তার স্ত্রী, সন্তান ও বাবা-মা থাকে তাহলে শ্রমিকসহ মোট সদস্য হবে ৫ জন। এই ৫ জনের জনপ্রতি খাবার খরচ ১২০ টাকাও ধরি (শিশুদের খাবার খরচ কম কিন্তু অন্য খরচ বেশি) তাহলে খরচ হবে ১৮ হাজার টাকা। তাই একজন শ্রমিকের যদি মাসিক খরচ হিসাব করি তাহলে মোট খরচ হচ্ছে ৩০ হাজার ৫০০ টাকা।
উল্লেখ্য, এখানে আমি এখানে মাসিক সঞ্চয়ের হিসাব ধরিনি। আমরা সবাই আমাদের ভবিষ্যতের নিরাপত্তা চাই। সন্তান ভবিষ্যতে দেখাশুনা করবে কি না তার গ্যারান্টি নেই। সেজন্য সবাই চায় ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চয় করে রাখতে। একটি পরিবারের যে খরচ হয় তার ৭০ শতাংশ আসে প্রধান উপার্জনকারীর থেকে। সে হিসেবে একজন শ্রমিকের বেতন হওয়া উচিত ২১,৩৫০ টাকা। ধরে নিই এটার পরিমাণ ২১ হাজার টাকা। তাহলে শ্রমিকেরা যে ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা বেতনের দাবিতে আন্দোলন করছে সেটা মোটেই অযৌক্তিক নয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যেই সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন সবাই বলে তার আমলে উন্নয়ন হয়েছে। তাদের এই উন্নয়নের মাপকাঠি কি? তাদের উন্নয়নের এই মাপকাঠি হলো দেশের জিডিপি বেড়েছে, উৎপাদন বেড়েছে, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়েছে। যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয় জিডিপি বৃদ্ধি, উৎপাদনকার্য এবং রাস্তাঘাট কে নির্মাণ করে থাকে? সবাই চোখ বন্ধ করে বলবে শ্রমজীবী মানুষ। আর যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয় দেশের সবচেয়ে অবহেলিত, কম মজুরি পাওয়া, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা এবং মাথাপিছু আয় কাদের সবচেয়ে কম? সেখানেও সবাই বলবে শ্রমজীবী মানুষ।
শ্রমিকেরা আসলেই সবক্ষেত্রে অবহেলিত। যে শ্রমিকেরা জিডিপি বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে তাদের মজুরি কেন কম হবে? শ্রমিকদের এই মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে সবসময় মালিকপক্ষ, সরকার এবং শ্রমিকদের মধ্যে একটা দ্ব›দ্ব কাজ করে। শ্রমিকদের এই আন্দোলনে আমরা দেখতে পেরেছি শ্রমিকদের প্রতিনিধি তাদের ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা দাবি করেছে, অন্যদিকে মালিকপক্ষ ১০ হাজার ৪০০ টাকার প্রস্তাব দিয়েছে। যেটা শ্রমিকদের দাবির অর্ধেক। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(খ)অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার। বর্তমানে শ্রমিকরা যে মজুরি পায় সে তুলনায় বাজারে দ্রব্যমূল্যের হার অনেক বেশি।
সুতরাং বলা যায়, শ্রমিকেরা তাদের যুক্তিসঙ্গত মজুরি পাচ্ছে না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, মন্ত্রী, এমপি সবার বেতন বৃদ্ধি পায় কিন্তু শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি পায় না। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবসময় ছিলেন শোষিতদের পক্ষে। তিনি ছিলেন একজন শ্রমিকবান্ধব নেতা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে নেতা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে কথা বলবেন সেখানে তার নিজেরই কয়েকটি কল-কারখানা রয়েছে। তখন সে মালিকপক্ষের ন্যায় আচরণ করবেন এটাই স্বাভাবিক।
এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বড্ডই অভাব দেখতে পাই আমরা। বাংলাদেশের দিন দিন উন্নতি হচ্ছে, অর্থনীতি পূর্বের তুলনায় শক্তিশালী হচ্ছে। কিন্তু, শ্রমিকদের সে তুলনায় জীবনযাত্রার মান বাড়ছে না। ফলে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। সমাজে আয়ের বৈষম্য একজন নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারকে ব্যাহত করে। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করবো বলে আমরা যতই গলাবাজি করি না কেনো শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি না করলে সেটা কখনো কার্যকর হবে না।
যারা সরকারি চাকরি করেন তারা চাকরির শেষে একটা পেনশন পান। যেটা দিয়ে তারা ভবিষ্যতে চলতে পারেন। কিন্তু শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই সুযোগটা নেই। সুতরাং, তারা যে ন্যূনতম মজুরি দাবি করেছে সেটা মোটেও অমূলক নয়। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পেলে উপরন্তু দেশেরই উন্নয়ন ঘটবে। কারণ শ্রমিকেরা যে টাকা পাবে তা দেশেই খরচ করবে। এতে করে ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। শ্রমিকদের ঠকিয়ে যারা অধিক মুনাফা অর্জন করে তারা সাধারণত দেশে কোনো টাকা খরচ করে না।
তারা টাকা বিদেশে পাচার করে, তাদের সন্তানদের বিদেশে পড়াশোনা করান, বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করেন। সুতরাং, শ্রমিকদের মজুরি কম হওয়া মানে দেশের ক্ষতি হওয়া। কিন্তু শ্রমিক মালিকেরা এটা কখনোই চাইবে না। শ্রমিকেরা যখনই আন্দোলন করে তখনই দেখা যায় পুলিশ দিয়ে তারা আন্দোলনকারীদের দমন করার চেষ্টা করে। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি না দিয়ে যদি তাদের দমন করার চেষ্টা করা হয় তাহলে কখনোই প্রতিষ্ঠানে শান্তি বিরাজ করবে না। দেশ ও জাতির কল্যাণে তাই শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে হবে।
তাই আজ কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি, তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি; তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান। শ্রমিকদের আন্দোলনে আমিও গাহি তাহাদেরি গান।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।