সিলেটে টেস্ট জয়ের কাব্যগাথা
স্পোর্টস ডেস্ক :
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৩৭ পূর্বাহ্ণ২০১৮-তে টেস্টে সিলেটের অভিষেকের আনন্দকে মনোবেদনায় মুড়িয়ে দিয়েছিলো হৃদয়ভাঙা এক পরাজয়ে। আর সেই টেস্টে তাইজুলের প্রথম ১০ উইকেট প্রাপ্তির কীর্তিও সেদিন ঢাকা পড়েছিলো হতাশার চাদরে। তারপর কেটে গেলো পাঁচ বছর। তবে ইতিহাস হয়তো ঘুরে ঘুরে আসে নতুন কোনও সৃষ্টির তরে। এবারো সেই সিলেট স্টেডিয়াম। সেবার প্রতিপক্ষ ছিলো জিম্বাবুয়ে, আর এবার প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। একই মাঠে, অভিন্ন আবহে আবারো ১০ উইকেট নিয়ে পাঁচ বছর আগের রং বদলে দিলেন সেই তাইজুল। দুঃস্বপ্নের সেই স্মৃতিকে পাল্টে ফেললেন মধুর স্মৃতিতে, একটি স্মরণীয় জয়ের কাব্যগাঁথায়…।
সিলেটে অভিষেকের সেই টেস্টে জিম্বাবুয়ের কাছে বাংলাদেশ হেরেছিলো ১৫১ রানে। আর এবার সেই সিলেটেই ১৫০ রানের জয় একঝাঁক তারকাসমৃদ্ধ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। কি এক অদ্ভূত মিল! সেই পরাজয় আর এই জয়ের মাঝখানে ব্যবধান মাত্র ১ রান!
ভরা হেমন্তের প্রাণবন্ত সময়ে অবশ্য জয়ের ঘ্রাণ বাতাসে উড়ছিলো আগের দিনের গোধূলী লগ্ন থেকেই। কাল শুধু সফল চিত্রনাট্যের মঞ্চায়নই হলো সিলেটের নির্মল সবুজে। টেস্ট চ্যাাম্পিয়নরশীপের প্রথম চক্রের শিরোপাজয়ীদের হতাশায় মাখিয়ে দিলো বাংলাদেশ।
মনে রাখার মতো এই জয়ে শুধু তাইজুলের সাফল্যগাঁথা পাঠ করাটা একটু কৃপনতাই হবে। এখানে আরেকটি চরিত্রও ঢকে গেছে ইতিহাসের সফল পাতায়। মূল অধিনায়ক সাকিব নেই দলে। ভারপ্রাপ্ত অধিনায়কের ভারী দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে যেভাবে সেঞ্চুরী হাঁকালেন ও নেতৃত্ব দিলেন-তাতে নাজমুল হোসেন শান্ত নতুন সম্ভাবনারই জয়গান গাইলেন।
খেলা শেষের প্রেস ব্রিফিংয়েও শান্ত বুঝাতে চাইলেন, সামনে পড়ে আছে অকুল মহাসমুদ্র। এটিও পাড়ি দিতে হবে। নিজের কাজ যে এখনও শেষ হয়নি, সেটিও নিজে থেকেই বললেন শান্ত। এই জয়ের বিশ্বাসকে সঙ্গী করে সিরিজ জয়ও নিশ্চিত করতে চান তিনি।
আর অপ্রত্যাশিত হারের পরও পেশাদারিত্বে অটল নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক টিম সাউদি। এমন ম্যাচ হারের পর উল্টো বাংলাদেশের পারফরম্যান্সের প্রশংসা করলেন। বললেন, শান্ত, তাইজুলদের অনমনীয় পারফরমেন্সের কারণেই এমন হার। খেলা শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে হতাশার চাদর সরিয়ে সাউদি মৃদু হেসে সিলেটের মাঠের প্রশংসা করতেও ভুললেন না।
অসাধারণ এই জয়ে ২০২৩-২৫ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ চক্রের শুরু করলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেল ভারতকেও। কিউইদের হারিয়ে ১০০ শতাংশ নিয়ে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট তালিকার ২ নম্বরে এখন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ওপরে থাকা পাকিস্তানেরও ১০০ শতাংশ। পাকিস্তান, বাংলাদেশের পরে ৩ নম্বরে আছে ভারত।
গত দুই চক্রের মতো এবারের টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপও হচ্ছে ৯ দল নিয়ে। জিতলে ১২ পয়েন্ট, টাই করলে ৬ পয়েন্ট এবং ড্র করলে ৪ পয়েন্ট পাবে দল। হারলে কোনো পয়েন্টই পাওয়া যাবে না। শতাংশের হিসেবে পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে থাকা দুই দল খেলবে ফাইনালে।
টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপে কে আগে, কে পিছে, কার কত পয়েন্ট-এই হিসেব হয়তো প্রাসঙ্গিক। তবে এসব ছাপিয়ে আরো প্রাসঙ্গিক সিলেটে কালকের জয়টা। ৭ উইকেটে ১১৩ রানে চতুর্থ দিন শেষ করেছিল নিউজিল্যান্ড। জয়ের জন্য শেষ দিনে তাদের করতে হতো আরও ২১৯ রান। হাতে ছিল কেবল ৩টি উইকেট। কিন্তু সেই সুযোগ কোনোভাবেই দেননি তাইজুলরা। দিনের শুরু থেকেই টানা ঘূর্ণি জাদুতে ড্যারিল মিচেল ও ইস সোধি রীতিমতো কোণঠাসায় পড়ে যান। এর মধ্যেও মিচেল তুলে নেন ৯ম টেস্ট ফিফটি। কিন্তু ফিফটির পর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি মিচেল। দিনের দশম ওভারে নাইমের বলে সুইপ করে ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান। মিচেল আউট হলে অষ্টম উইকেটে সোধির সঙ্গে ভাঙে ৯১ বলে ৩০ রানের জুটি। বিশেষ ব্যাটারদের চেয়ে লোয়ার অর্ডারের ব্যাটাররাই বেশ ভুগিয়েছে বাংলাদেশ দলকে। নবম উইকেটে সোধি ও টিম সাউদি মিলে প্রতিরোধের আরেকটি চেষ্টা চালান। ৫১ বলে ৪৬ রানের দারুণ একটি জুটি গড়েছেন দুজনে।
দিনের ১৯তম ওভারে সাউদিকে থামিয়ে ব্রেক থ্রু এনে দেন তাইজুল। নিচু বল লেগ সাইডে খেলতে গিয়ে শর্ট মিডউইকেটে জাকির হাসানের হাতে জমা পড়ে। ২৪ বলে ৩৪ রানের ঝোড়ো ইনিংস খেলে ফিরেন কিউই অধিনায়ক। শেষ উইকেটে এজাজ প্যাটেল ও সোধি জুটির স্থায়িত্ব ছিল ৩ রান। এরপর সোধিকে ফিরিয়ে ম্যাচ শেষ করেন তাইজুল। ৯১ বলে ২২ রানের ইনিংস খেলেছেন সোধি। শেষ পর্যন্ত ১৮১ রানের বেশি এগুতে পারেনি নিউজিল্যান্ড।
গত বছর নিউজিল্যান্ডকেই তাদের মাঠে টেস্টে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টের সেই জয়কে মনে করা হয় বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের সেরা জয়। এবারও এই সিরিজে পূর্ণ শক্তির নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সাকিব-লিটনদের ছাড়া সিলেটের এই জয়ও অমলিন থাকবে দীর্ঘকাল।
বিশ্বকাপের অমোচনীয় ব্যর্থতা ঢাকতে প্রয়োজন ছিল মাঠের পারফরম্যান্স। ফরম্যাট যেমনই হোক একটি জয় এনে দিতে পারে স্বস্তি। স্বস্তির সেই জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের ক্ষতে প্রলেপ লেগেছে, হোক অল্প তবুও।
সিলেট টেস্টে টস জিতে আগে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাংলাদেশ। মাহমুদুল হাসান জয়ের ফিফটি (৮৬) ও বাকিদের কার্যকরী কিছু ইনিংসের সৌজন্যে প্রথম ইনিংসে ৩১০ রান তুলেছিল তারা। বিপরীতে কেন উইলিয়ামসনের (১০৪) সেঞ্চুরির কল্যাণে নিউজিল্যান্ডের প্রথম ইনিংস থামে ৩১৭ রানে।
৭ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে শান্তর সেঞ্চুরি (১০৫), মুশফিকুর রহিম (৬৭) ও মেহেদী হাসান মিরাজের (৫০) ফিফটিতে স্কোরে ৩৩৮ রান জমা করে বাংলাদেশ দল। সিলেটের মাঠে টেস্টে এটিই সর্বোচ্চ স্কোর। তাতে স্বাগতিকদের লিড হয় ৩৩১। নিউজিল্যান্ডের লক্ষ্য হয় ৩৩২ রান। কিন্তু সেই লক্ষ্য তাড়া করতে গিয়ে তাইজুল জাদুতে পরাজয়ের মালা পরতে হয় অতিথিদের।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৩১০। নিউজিল্যান্ড ১ম ইনিংস: ৩১৭।
বাংলাদেশ ২য় ইনিংস: ৩৩৮। নিউজিল্যান্ড ২য় ইনিংস: ৭১.১ ওভারে ১৮১।
ম্যান অব দা ম্যাচ: তাইজুল ইসলাম।