কর্মযোগী মুহিত ছিলেন বরাবরই মেধাবী ছাত্র। তিনি যেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন, তেমনি আবার প্রাইমারি ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্যও হয়েছিলেন। তাঁর এ ধরনের সাফল্য ও ব্যর্থতার কথা অকপটে বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সাথে `প্রিয় মানুষের মুখোমুখি` কলামে সাক্ষাৎকারে যা বর্তমান ছাত্র-সমাজের জন্য বিশেষ অনুকরণীয়। বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের শিক্ষা জীবনের বিচিত্র গল্প তাই তুলে ধরা হলো ছাত্র-যুবকদের প্রেরণার উদ্দেশ্যে।
দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত সিলেট। ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রত্যেক আন্দোলনে সে সময়ে সিলেটের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। স্বাধীকার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠকদের জন্ম সিলেট জেলাতেই। এ কারণে বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে স্বাধীকার আন্দোলনে সিলেটের সেই অনবদ্য ও গৌরবোজ্জল ভূমিকাকে স্মরণ করে তুষ্ট এখানকার মানুষ।
ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই পরবর্তী সব আন্দোলন-সংগ্রামের ডালপালা গজিয়েছিল। তাই ভাষা আন্দোলন বাঙালির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়- যার রয়েছে বিশাল এক প্রভাব।
ভাষা আন্দোলনের প্রভাব ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক বলেছিলেন, আমাদের জাতীয়তাবাদ ও বাঙালিয়ানার জোয়ার কিন্তু ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির মধ্য দিয়েই এসেছে। একুশের চেতনার প্রসারিত প্রভাব থেকেই ৬ দফা, ছাত্রদের ১১ দফা ও মওলানা ভাসানীর ১৪ দফা। এগুলোর সম্মিলিত ফলাফলই হল ’৬৯-এর গণজাগরণ। তার পরিণামে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। তাই আমি সবসময় বলি, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার।
ভাষা সংগ্রামীরা জানান,রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করেই বাংলাদেশের উৎপত্তি। আমাদের জাতীয়তাবোধের সবকিছুই শিখেছি ভাষা আন্দোলন থেকে। আমরা বাঙালি, বাংলা ভাষায় কথা বলি, আমাদের দেশ বাংলাদেশ- এসব বোধ এ আন্দোলন থেকেই পাওয়া। ভাষা আন্দোলন থেকেই উৎসারিত হয়েছে সব মন্ত্র।
ভাষা শহীদদের স্মরণে সিলেটে অসংখ্য দোয়া মোনাজাত করা হয়েছিল। আছে অনেক স্থাপনা বিশেষ করে প্রথম শহীদ মিনারটি তৈরি হয়েছিল সিলেট সরকারী কলেজে ১৯৬৭ সনে। তবে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় এখনো সিলেটে যারা বেঁচে আছেন, তাদের একজন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব,আবুল মাল আবদুল মুহিত একাধারে লেখক গবেষক, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ ও অর্থনীতিবিদ হিসেবে সুপরিচিত।
তিনি ১২ বছর বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। লেখক হিসেবে সুপরিচিত মুহিত তিনি বহু গ্রন্থের প্রণেতা। তিনি বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় লিখে থাকেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ এই গুণী ব্যক্তিত্ব স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেছেন।
ইতিহাস থেকে জানাযায়, ১৯৩৪ সালে সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত কৈশোরে ছাত্র সংগঠন এবং ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। সেসময় সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ও সর্বদলীয় কর্মপরিষদের আহবায়ক থাকাকালে কিছুদিন জেলেও ছিলেন।
১৯৮১ সালে ২৫ বছরের সরকারি চাকরির পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব হিসেবে স্বেচ্ছা অবসরে যান। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে পরিবেশ আন্দোলন গড়ে উঠে। প্রথমে পরশ এবং পরে বাপা-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালামনাই এসোসিয়েশনেরও পরপর দুই মেয়াদে সভাপতি ছিলেন।
কর্মজীবনে পূর্ব পাকিস্তান এবং কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারে প্রায় ১৩ বছর চাকরি করে ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে অর্থনৈতিক কাউন্সিলর হিসেবে নিযুক্তি পান ১৯৬৯ সালে। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানের আনুগত্য অস্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ’৭১ সালে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়াশিংটন দূতাবাসে ইকনমিক কাউন্সেলরের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সংগ্রহে বিশ্বব্যাপী কাজ করেন। ভাষাসৈনিক সম্মাননা ২০২০ স্মারকগ্রন্থ ‘শব্দগান রক্তমিতা’য় প্রকাশিত থেকে জানাযায়,বিগত ১৯৬৯ সালে এএমএ মুহিত যুক্তরাষ্ট্রস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের ইকনমিক কাউন্সিলর পদে যোগদান করেন। তখন গড়ে উঠে ১৯৬৯ সনের গণ অভ্যুত্থান।
১৯৭০ এর নির্বাচন ও পাকিস্তানীদের বৈরিতা এএমএ মুহিতকে ব্যথিত করে তোলে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন তিনি পাকিস্তান এর পক্ষ ত্যাগ করে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
কলকাতা ও দিল্লিস্থ পাকিস্তানী সরকারি কয়েকজন চাকরিজীবীর পরে বহির্বিশ্বে^ তিনিই প্রথম পাকিস্তানী সিনিয়র কূটনৈতিক যিনি বাংলাদেশের পক্ষে পাকিস্তান এর কূটনৈতিক দায়িত্ব ত্যাগ করেন। দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা সচিব এবং ১৯৭৭ সালে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
আবুল মাল আবদুল মুহিত তৎকালীন ভারতে ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি, রবিবার সিলেট শহরের এক ঐতিহ্যবাহী সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবু আহমদ আবদুল হাফিজ এডভোকেট এবং মাতার নাম সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরী। পিতা-মাতার ১৩ মেধাবী সন্তানের মধ্যে আবুল মাল আবদুল মুহিতের অবস্থান তৃতীয়। পিতা-মাতা আদরে তার ডাক নাম রাখেন -শিশু। শিশুসুলভ সরলতায় ভরা আবুল মাল আবদুল মুহিতের বর্তমান বয়স ৮৮ বৎসর পূর্ণ হয়েছে।
সিলেট/এসএম-২৬