৫২টি ভাষায় ‘মা’ শব্দ দিয়ে নির্মিত দেশের প্রথম শহীদ মিনার
নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৩:৫৪ অপরাহ্ণ২১ বাঙালির কাছে শুধু মাত্র একটি সংখ্যা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলা ভাষাভাষীর মানুষের এক শোকাবহ দিনের ক্ষতবিক্ষত স্মৃতি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালির জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। যে অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে।
বাঙালির সেই চেতনা ধরে রাখতে ১৯৫২ সালেই তৈরি হয়েছিল শহীদ মিনার। ভাষা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই, বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত প্রহরের দুই দিন পর ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তৈরি করেন প্রথম শহীদ মিনার। সাঈদ হায়দার ছিলেন ওই শহীদ মিনারের নকশাকার।
নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই চেতনা জাগ্রত করতেই সিলেটের লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হলো, ৫২ টি ভাষার সংমিশ্রণে মা শব্দে শহীদ মিনার। শহীদ মিনারটির উচ্চতা ৩৮ ফুট, চওড়া ৬০ ফুট। মূল অংশ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে। ঠিক মধ্যভাগে ‘মা’ শব্দটি বড় করে বাংলায় লেখা। তারপর থরে থরে আরও মা লেখা। তবে সেগুলোর ভিন্ন ভিন্ন ভাষার নানা বর্ণে। বাংলা ভাষা, জনজাতি ও আঞ্চলিক উচ্চারণে মা ডাকও আছে। সেই সঙ্গে ইংরেজি থেকে শুরু করে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভাষায় লেখা মায়ের নাম। যেন এক স্থাপত্যে সব মা। রয়েছে সংস্কৃতি, হিন্দি, চাকমা, মারমা, রাখাইন ভাষায় লেখা মা। রয়েছে বাংলা কালজয়ী কবিতার পংক্তি মালা।
মা স্থাপত্যের এই শহীদ মিনার সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক স্থপতি রাজন দাসের নকশায় এটি নির্মিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫ শতক জায়গায় এ শহীদ মিনারটির মূল কাঠামো নির্মাণকাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এখন চলছে নানা ভাষা আর বর্ণমালায় মায়ের নাম বসানোর কাজ।
সিলেটের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লিডিং ইউনিভার্সিটি। নগরের কেন্দ্রস্থলের মধুবন মার্কেট এলাকায় অস্থায়ী ক্যাম্পাসের মাধ্যমে ২০০১ সালে যাত্রা শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়টির। শহীদ মিনারজুড়ে শুধু মা কথার আচ্ছাদনে তৈরি হয়েছে অন্য রকম এক আকর্ষণ।
শহীদ মিনার সব উঁচুতেই হওয়া উচিত, এমন এক ভাবনা থেকে স্থপতি রাজন দাস টিলার চূড়ায় সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার নির্মাণ করে প্রশংসা কুড়ান। এরপর মদনমোহন কলেজ ক্যাম্পাসসহ সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ-স্মারক স্তম্ভ নির্মাণ হয়েছে রাজন দাসের ভাবনায়।
বাংলা ভাষায় মা কথার সঙ্গে ‘আম্মা’, ‘মাই’ ও ‘মাইজি’ আঞ্চলিক উচ্চারণের শব্দও সংগ্রহ করা হয়েছে। ‘মা’ শব্দ সন্ধান তৎপরতায় এ পর্যন্ত বাংলা ভাষা ছাড়াও সিলেটের মণিপুরি মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়াসহ বসবাসরত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বর্ণমালার মা উচ্চারণের ১৪টি লিপি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চাকমা, মারমা, ম্রো (মুরং), বম, রাখাইন, ত্রিপুরা, সাঁওতাল (অলিচিকি), ওঁরাও, সিলেটি নাগরীর সঙ্গে অহমিয়া, মিজো, গারো সম্প্রদায়ের লিপি থেকে মা শব্দ নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া সংস্কৃত, ব্রাহ্মীলিপি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি, ব্রজবুলি, মালায়লাম, তেলেগু, তামিল, গজরাটি, বার্মিজ, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, জার্মান, রোমন ও গ্রিক ভাষায় মায়ের নাম লিপি সংগ্রহ হয়েছে। বাংলা ভাষায় মায়ের নামের সঙ্গে থাকবে মাকে নিয়ে রচিত কালজীয় কবিতার পঙ্ক্তিও।
রাজন দাস তার এই স্থাপত্যকর্মের নাম দিয়েছেন ‘রিপ্রেজেন্টেশন অব মাদার’। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মরণে এই শহীদ মিনার নির্মাণ করা হলেও এর মধ্য দিয়ে মা শব্দটি সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এত উঁচু শহীদ মিনার দেশে খুব একটা নেই। এই উচ্চতা শুধু মা ও মাতৃভাষাকে সবার উপরে রাখার ইচ্ছে থেকে করা। সব ভাষায় মা শব্দ এখানে বসানোর একটাই লক্ষ্য, সেটি হচ্ছে পৃথিবীজুড়ে মায়ের ভাষাকে সম্মান জানানোর সঙ্গে মাকে প্রার্থনা করার মতো করে এক জায়গায় রাখা।’
নির্মাতার মতে, এই শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়ালেই মনে পড়বে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দলনের কথা। মনে পড়বে ভাষা শহীদদের কথা। পৃথিবির একমাত্র জাতি যারা তাদের ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাভাষীর মা ডাকের মধ্যে বাংলা শব্দের “ম” এবং ইংরেজিতে “এম” পাওয়া যায়। এই শহীদ মিনার সব মাকে মাতৃভাষার জন্য অনন্য এক উচ্চতায় তুলে ধরে স্মরণ করবে এমনই মত আয়োজকদের।
বাংলা নিউজ এনওয়াই-এবিএ/07