২০০ বছর আগের ব্যর্থ কবিই বর্তমান বিশ্বের অনুপ্রেরণা
নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৩:১৭ অপরাহ্ণযুগে যুগে অনেক কবি সাহিত্যক এই পৃথিবীতে এসেছেন। রেখে গেছেন অনেক কালজয়ী শিল্পকর্ম। তবে রোমান্টিক ঘরনার লেখা সবাই লিখতে পারেননি। তাদের প্রেম আর ভালোবাসার আবেগ অন্যদের মন ছুতে পারেনি সেভাবে। রোমান্টিক সাহিত্যকর্মের জন্য ইংরেজি সাহিত্যের বেশ খ্যাতি রয়েছে। আর লর্ড বায়রন ও পার্সি বিশি শেলির সঙ্গে জন কিটসও ছিলেন দ্বিতীয় প্রজন্মের রোমান্টিক কবিদের একজন।
মাত্র ২৫ বছরের জীবনে কবিতা ছাড়া কিটস কোনো গদ্য লেখার চেষ্টা করেননি। তার কবিতা ইন্দ্রিয় বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক। তার কাব্যজীবন ছিল মাত্র ছয় বছর (১৮১৪-১৮১৯)। অর্থাৎ ১৯ থেকে ২৪ বছর বয়সে তিনি তার কালজয়ী শিল্পকর্মগুলো করেছেন। অনেকেই ভাবিয়ে তুলেছে তার বয়স, এতো অল্প বয়সে কীভাবে তিনি এতোটা আবেগমাখা লেখা লিখেছিলেন। এটা যেমন তাকে নিয়ে চর্চার বিষয় ছিল, তেমনি সমালোচলার অংশ ছিল জন কিটসের উঠা, বসা, চলাফেরা সবকিছুইই। এমনকি মৃত্যুর পরও রেহাই পাননি সমালোচনা থেকে।
১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর লন্ডনের মুরগেটের এক আস্তাবলে জন্মগ্রহণ করেন জন। তার পিতা থমাস কিটস এবং মা ফ্রান্সিস জেনিং। ২০০ বছর আগের কথা। লন্ডন শহরের প্রাণকেন্দ্রে ছিল একটি আস্তাবল। এমনি একটি আস্তাবলের পরিচালক ছিলেন টমাস কিটস। নিচে আস্তাবল, উপরে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন টমাস। স্ত্রী আস্তাবলের মালিকের মেয়ে। কাজের প্রয়োজনে টমাসকে যেতে হতো মালিকের বাড়িতে। সেখানেই দুজনের দেখা, তারপর প্রেম, একদিন বিয়ে।
বিয়ের এক বছর পর ১৭৯৫ সালের অক্টোবর মাসে টমাস কিটস ও ফ্রান্সিস জেনিং দম্পতির প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। যথাসময়ে শিশুর নামকরণ করা হলো জন কিটস। ১৮০৪ সালে তার বাবা টমাস কিটস ঘোড়া থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর কিটসের মা রলিগুস নামে একজনকে বিয়ে করেন। তবে অল্পদিনেই দুজনের সম্পর্কে ফাটল ধরল। এক বছরের মধ্যেই বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় তাদের। এর পর ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি এলেন কিটসের মা। কিটস তখন ১০ বছরের ছেলে। একটু বেঁটেখাটো চেহারা হলেও আয়ত চোখ আর কোঁকড়ানো সোনালি-বাদামি চুলে জনকে দেখতে লাগত ঠিক দেবশিশুর মতো। ১৮১০ সালে মারা গেলেন কিটসের মা। মৃত্যুর আগে নিজের অজান্তেই রাজরোগ যক্ষ্মার বীজ দিয়ে গেলেন সন্তানদের।
জন প্রথমে এনফিল্ডের একটি স্কুলে ভর্তি হন। টাকার অভাবে দামি কোনো স্কুলে পড়তে পারেননি জন। তাতে কি? পড়াশোনায় জনের ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। দিন-রাত পড়াশোনা নিয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে মনের খেয়ালে কবিতা লেখেন। ১৫ বছর বয়সে স্কুলের পড়া শেষ হলো। কিটসের অভিভাবকের ইচ্ছা কিটস ডাক্তারি পড়বেন। ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি হলেন মেডিকেল কলেজে। তবে যার মনের মধ্যে জেগে উঠেছে কবিতার নেশা, হাসপাতালের ছুরি কাঁচি ওষুধ রোগী তার ভালো লাগবে কেন। সার্জারির ছুরি, কাঁচি, মেডিসিনের ক্লাস কেটে প্রায়ই চলে যেতেন সাহিত্যের আডডায়। এভাবেই এক সাহিত্যসভায় আলাপ হয়ে যায় প্রায় সমবয়সী কবি শেলীর সঙ্গে। আলাপ গড়ালো বন্ধুত্বে। সৌভাগ্য সেই সময় শেলী তাকে কিটসকে নিয়ে গেলেন তখনকার খ্যতিমান তরুণ কবি লে হান্টের কাছে।
হান্টের সঙ্গে পরিচয় কিটসের জীবনে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। হান্ট কিটসের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হলেন, তাকে আরো কবিতা লেখার জন্য উৎসাহিত করলেন। হান্ট একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সেই পত্রিকাতেই কিটসের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হলো। এখানে কিটসের পরিচয় হলো শেলীর সঙ্গে। আর ডাক্তারির মোহে নিজেকে বেঁধে রাখতে পারলেন না। অভিভাবকের উপদেশ অগ্রাহ্য করে ১৮১৬ সালে মেডিকেল কলেজ ছেড়ে দিয়ে পরিপূর্ণভাবে কবিতায় মনোনিবেশ করেন। ১৮১৮ সালে কিটসের ভাই টম মারাত্মকভাবে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন এবং কিটস তার সেবা যত্ন করেন। তবে টম ডিসেম্বরে মারা যান। এর পরে কিটস তার বন্ধু চার্লস ব্রাউনের হ্যাম্পস্টেডর বাসায় থাকতে শুরু করেন।
এখানে ফ্যানি ব্রন নামে ১৮ বছরের এক তরুণী প্রতিবেশীর প্রেমে পড়ে পরেন কিটস। ফ্যানি ব্রন ছিলেন সুন্দরী প্রাণোচ্ছল তরুণী। কয়েক দিনের পরিচয়ে ভালো লেগে গেল দুজনের। কিটস ফ্যানিকে বিয়ে করতে চাইলেন। ফ্যানি সম্মত হলেও সংসার অভিজ্ঞ মিসেস ব্রন তৎক্ষণাৎ কোনো সম্মতি দিলেন না। বললেন, আগে কিটস স্বাবলম্বী হয়ে উঠুক তারপর বিয়ে হবে। কিটস স্থির করলেন যেমন করেই হোক তাকে অর্থ উপার্জন করতেই হবে। স্বাস্থ্য আগের মতো ভালো যাচ্ছিল না। তবে মনের অদম্য শক্তিতে কিটস লিখে চললেন একের পর এক কবিতা।
এরপর থেকেই কিটসের সৃষ্টিশীল সময়ের সূচনা হয়। প্রকৃতপক্ষে কিটসের জীবনের সমস্ত শ্রেষ্ঠ কবিতাই এই সময়ে লেখা। অল্পদিনের মধ্যে কিটস প্রকাশ করলেন তার প্রথম কবিতা সংকলন। সকলের মনে আশা ছিল এই বই নিশ্চয়ই জনপ্রিয় হবে। তবে দুর্ভাগ্য কিটসের, পরিচিত কিছু লোকজন ছাড়া এই বইয়ের একটি কপিও বিক্রি হলো না। প্রথম কাব্য সংকলনের ব্যর্থতায় সাময়িক আশাহত হলেন কিটস। তবে অল্পদিনেই নতুন উৎসাহে শুরু করলেন কাব্য সাধনা। লেখা হলো প্রথম দীর্ঘ কবিতা এন্ডিমিয়ন। এ এক অসাধারণ কবিতা। এই কবিতার প্রথম লাইনের মধ্যেই কিটসের জীবন দর্শন ফুটে উঠেছে। লিখেছিলেন এ থিংক অব বিউটি ইজ জয় ফরেভার।
জন এবার আশা করেছিলেন তার এই কবিতা নিশ্চয়ই খ্যাতি পাবে। কিন্তু তৎকালীন দুটি পত্রিকা ব্ল্যাকউড ম্যাগাজিন এবং কোয়াটার্লি রিভিউ তীব্র ভাষায় কিটসের নামে সমালোচনা করল। তীব্র বিদ্বেষপূর্ণ সমালোচনা প্রকৃতপক্ষে কিটসের মানসিক শক্তিকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। তা ছাড়াও আর্থিক অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না কিটসের। কিটসের শরীর যতই ভেঙে পড়ছিল ততই ফ্যানি তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। তার সাজগোজ হাসি, অন্য ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা কিটস সহ্য করতে পারতেন না। তার সমস্ত অন্তর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত।
এরপর লন্ডনে ফিরে এলেন কবি জন কিটস। একদিন বাইরে বেড়াতে বেরোলেন তিনি। বাড়িতে ফিরে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল, সেই সঙ্গে কাশি। এক ঝলক রক্ত উঠে এল মুখ দিয়ে। কিটস বললেন, একটি মোমবাতি নিয়ে এস। ব্রাউন মোমবাতি নিয়ে আসতেই কিটস কিছুক্ষণ রক্তের দিকে চেয়ে বললেন, এই রক্তের রং আমি চিনি, এ রক্ত উঠে এসেছে ধমনী থেকে। এই রক্ত আমার মৃত্যুর সমন। ডাক্তার এল। সে যুগে যক্ষ্মার কোনো চিকিৎসা ছিল না। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে শিরা কেটে কিছুটা রক্ত বের করে দেয়া হলো। কিন্তু তাতে কোনো সুফল দেখা গেল না। তখন তার বয়স মাত্র ২৫ বছর। গলার স্বর ভেঙে গিয়েছিল, মাঝে মাঝেই জ্বর হতো, গলা দিয়ে রক্ত উঠে আসত, এই সময় তার সৃষ্টির উৎসও ফুরিয়ে আসছিল।
১৮২০ সালের শুরুর দিকে কিটসের যক্ষ্মার লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। ওই বৎসরের জুলাই মাসে তার কবিতার দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ হয়। কিন্তু তখন সে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেপ্টেম্বরে উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে কিটস ও তার বন্ধু জোসেফ সেভার্ন ইতালি গমন করেন। তারা আশা করেছিল এতে কিটসের স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে। তারা যখন রোম পৌছান তখন কিটস অসুস্থতার কারণে বিছানায় পড়ে যান। কিটসের বন্ধু সেভার্ন তাকে যথাসাধ্য সেবা যত্ন করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ১৯২১ সাল। সমস্ত দিন কেমন আচ্ছন্ন ছিলেন কিটস। রাত তখন প্রায় ১১টা, মাথার পাশে বসে ছিল বন্ধু সেভার্ন। আস্তে আস্তে কিটস বললেন, ‘আমাকে তুলে ধর, আমার মৃত্যু এগিয়ে এসেছে। আমি শান্তিতে মরতে চাই, তুমি ভয় পেয়ো না-ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, অবশেষে মৃত্যু এল।’
মাত্র ২৫ বছর বয়সে ১৮২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী ইতালীর রোমে সেভার্নের কোলেই চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়লেন চিরসুন্দরের কবি কিটস। মৃত্যুর পর তাকে রোমের প্রটেস্টান্ট সিমেটারিতে কবর দেয়া হয়। মৃত্যুর পর কিটসের শেষ ইচ্ছে অনুসারে তার সমাধিতে রাখা হয়েছিল ফ্যানির একগোছা চুল আর তার হাতে লেখা একটা চিঠি। এর ঠিক দুই বছর পরে এই সমাধিক্ষেত্রেই সমাধি দেয়া হয় আরেক তরুণ কবি শেলীকে।
কবিতায় কল্পনার সৌন্দর্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন কিটস। সৌন্দর্যই ছিল তার কাছে শেষ সত্য, আর কল্পনার মধ্য দিয়েই তাতে উপনীত হওয়া যায় বলে মনে করতেন তিনি। মাত্র ২৫ বছর বয়সে শেষ হয়ে গিয়েছিলেন জন কিটস। ইতিহাস বলছে, যক্ষ্মাই কেড়ে নিয়েছিল এই তরুণ কবির প্রাণ। তবে কিটসের মৃত্যুর পর কথাপ্রসঙ্গে শেলী বলেছিলেন , যক্ষ্মা তাকে ততটাও মারেনি , যতটা মেরেছিল সমালোচকেরা। নেহাত ভুল নয় কথাটা।
অল্পবয়সে বাবা-মা’কে হারানো, ভাঙা পরিবারে স্নেহহীন অভিভাবকত্ব, প্রেম-অপ্রেমের দোলা, এমনকি কবি হিসেবেও দিনের পর দিন আঘাত আর অপ্রতিষ্ঠা- তাকে সত্যিই অভিমানী করে তুলেছিল। বিষাদ ছিল, আর ছিল ভালোবাসার জন্য গভীর আর্তি। লেখালিখির জীবন মাত্র ছ’বছরের। প্রকাশকাল ধরলে আরো কম। জীবদ্দশায় প্রকাশ পেয়েছে মাত্র ৫৪ টি কবিতা। ছোট-বড় মিলিয়ে বাকি লেখা বেরিয়েছে তার মৃত্যুর পরে। কিছু চিঠিপত্র লিখেছেন প্রেমিকা আর বন্ধুদের, সাহিত্যমূল্য কম নয় তারও।
বিশেষত ফ্যানিকে লেখা তার প্রেমের চিঠিগুলোকে বলা হয় বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রেমপত্র। কবি হিসাবে যোগ্যতার কোনো দামই পাননি জীবনভর। সার্থকতা পাননি প্রেমিক হিসাবেও। অথচ সেই ব্যর্থ কবিই বিশ্বজুড়ে আজ কত মানুষের অনুপ্রেরণা। পুরো পৃথিবীর প্রেমিক আর কবিদের ধ্রুবতারা তাকে তিনিই স্যার জন কিটস। মৃত্যুর ২০০ বছর পরেও তার কবিতা আজও অনুবাদ হয় নানা দেশে নানা ভাষায়, যাকে নিয়ে আজও লেখা হয় অজস্র প্রবন্ধ, আলোচনা, গবেষণার বই।
বাংলা নিউজ এনওয়াই-এবিএ/14