লকডাউনে ভয়াবহ সঙ্কটে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ
নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ এপ্রিল ২০২১, ১২:৩৫ অপরাহ্ণকরোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকায় গত ৫ এপ্রিল থেকে দেশে দ্বিতীয় দফায় কঠোর বিধিনিষেধ (লকডাউন) জারি হয়েছে। আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত এই লকডাউনের মেয়াদ বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে সরকার। দীর্ঘমেয়াদি এই লকডাউনে গভীর সঙ্কটে পড়েছেন মুচি থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। নিম্ন আয়ের মানুষ তিনবেলা দু-মুঠো ভাত যোগাতেও হিমশিম খাচ্ছেন।
অন্যদিকে গত লকডাউনের প্রভাব কিছুটা কাটিয়ে না উঠতেই নতুন করে লকডাউনে পড়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে আছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা। সার্বিকভাবে ভয়াবহ সঙ্কটে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ।
এদিকে গত বছর লকডাউনে নানা ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করলেও এবার তেমন উদ্যোগও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। হতদরিদ্ররাও সরকারের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত তেমন সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলেও তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
কেউ বলেছেন চরম অর্থকষ্টের কথা, কেউ বলেছেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা। কেউ আবার স্বপ্ন সাজানোর পথে হোঁচট খাওয়ার কথা বলতে গিয়ে হয়েছেন আবেগতাড়িত।
দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া বাসায় সিলেটে থাকেন মোহন বর্মন। জিন্দাবাজার লন্ডন ম্যানশন এ দর্জির কাজ করেন তিনি। কিন্তু লকডাউনে পরিবার নিয়ে বেশ বিপাকে আছেন। একদিকে যেমন দোকান খুলে ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না, অন্যদিকে তেমন কাজও পাচ্ছেন না। দিনশেষে ৪০ থেকে ৫০ টাকার বেশি ঘরে তুলতে পারছেন না বলে জানান মোহন। এতে অনেকটা অর্ধাহারে পরিবার নিয়ে দিনাতিপাত করছেন তিনি।
সিলেটের মদিনা মার্কেটে মোড়ে ফলের দোকান দিয়েছেন আবির হাসান। প্রথম সপ্তাহ লাভের মুখ দেখলেও দুই সপ্তাহ ধরে বিক্রি কম, এর মধ্যে আবার কিছু মালামালে পচন ধরেছে। এতে লোকসানের মুখে পড়েছেন তিনি।
আবির হাসান বলেন, ‘নিয়মিত দোকান করতে পারি না। সকাল ১০টায় খুলি, বিকেল ৩টায় বন্ধ করে ফেলতে হয়। ৩টার উপরে গেলে পুলিশ ধাওয়া দেয়। কাঁচামাল তো পচে যায়। টেনশনে থাকি। এই তিনদিনে দুই কার্টন আপেল ফেলছি। মাল্টা পাঁচ কেজির মতো ফেলে দিছি। আর আঙুর গেছে প্রায় অর্ধাঅর্ধি। আঙুর বেশি পচে। তারপর থেকে আর আঙুর আনি না। সবমিলিয়ে আমার প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকার মাল পচে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের আইন তো মানতে অইবো। কিন্তু পেটতো আর মানে না। কিস্তি, বাসা ভাড়া এগুলো তো আর মানবো না। নিজের একটা খরচ আছে। গ্রামের বাড়িতে থাকা বউ-বাচ্চাদের জন্য টাকা পাঠাতে হচ্ছে। অথচ ব্যবসায় লাভ নাই, বরং ক্ষতির মধ্যে আছি। সবমিলিয়ে বর্তমানে একটু কষ্টে আছি।’
সুনামগঞ্জের টুকেরবাজার গ্রামের বাড়িতে মা, বউ, এক ছেলে ও এক মেয়ে থাকে রিকশাচালক আরশ আলীর। গত বছর জারি হওয়া প্রথম দফার লকডাউন কেটে গেলে সিলেটে আসেন তিনি। তারপর মাত্র একবার তিনি গ্রামের বাড়িতে গেছেন। সংসার চালাতে সিলেটে রিকশা চালিয়ে যাচ্ছেন অনবরত।
লকডাউনে রিকশা চালানোর বিষয়ে আরশ আলী বলেন, ‘রাস্তাঘাটে গদি-মদি খুইলে রাখছে পুলিশ। অনেক সময় তো যাত্রী নামায়ে দিতেছে। খুবই কষ্টে আছি। বাড়িতে ছেলেপেলে, মা আছে। তারা রোজা থাকে। তাদের তো একটা আহার আছে। আমরা তো অইডা পারছি না দিতে। আমাদের গদি খুইলে রাখছে। আমাদের রুজিই বন্ধে হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘রিকশা চলে। কিন্তু কোন সময় কী করছে, তা তো বলা যাচ্ছে না। কালকে এইরকম আম্বরখানা বসে আছি, গপ কইরা মোটরসাইকেল এসে গদি খুইলে নিয়ে গেল। কী করব কও, কিচ্ছু করার নাই। পরে এক ঘণ্টা রাইখা আবার দিয়া দিল। ইনকাম আছে। কিন্তু করতে তো পারছি না। ভয়ে ভয়ে এভাবে তো করা যায় না। চুরি করছি না, বদমাইশি করছি না, রুজি করবো তাও ভয়। এইটা একটা দেশ হলো কওছান?’
লকডাউনে অনেকে শপিংশল, দোকানপাট খুলতে পারছে না। আপনারা তো রিকশা চালাতে পারছেন। এর জবাবে আরশ আলী বলেন, ‘ওদের তো আছে। আমাদের তো কোনতা নাই। আমাদের তো শরীরের ওপর দিয়ে চলে। আমাদের শরীরটা অচল থাকলে হাড়ি শিকেয় থাকে। শরীর চললে সংসার চলে।’
‘যারা বড়লোক তারা ঘর থেকে বের হয় না। তাদের খাবার আছে। যারা গার্মেন্টস কর্মী, তারা তো ৩০ টাকা ভাড়া দেবে না। ওরা তো হিসাব করে চলে’, বলেন এই রিকশাচালক।
সিলেটের শিবগঞ্জ এলাকার শাহাবুদ্দিন ফার্নিচারে ১০ জনের বেশি লোক কাজ করেন। লকডাউনেও তাদের কাজ থেমে নেই। দোকানের শাটার বন্ধ করে চলে তাদের কাজ। কাজ চললেও সেসব ফার্নিচার বিক্রি করতে পারছেন না তারা।
এই ফার্নিচার দোকানের রং মিস্ত্রি ইমরান বরেন, ‘আমরা কাজ করতেছি, কিন্তু মহাজন কোনো মাল বিক্রি করতে পারছেন না। এবার প্রথম যে লকডাউন দিয়েছে, তারপর থেকেই বিক্রি কমে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘ফার্নিচার আমরা বানিয়েও বিক্রি করি, আবার অর্ডার দিলেও সেটা বানিয়ে দিই। কিন্তু বর্তমানে কোনো কাজের অর্ডার পাইতেছি না। আমরা এখন যা বানাচ্ছি, সেগুলো স্টোরেজে রাখতেছি।’
এখন পর্যন্ত সবারই বেতন হচ্ছে। এভাবে ঘাটতি দিতে থাকলে সামনের দিনগুলোয় কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন ইমরান।
গত বছর লকডাউনের সময় কুমিল্লায় গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন পলাশ দাস। কাজ না থাকায় সেই সময় কঠিন আর্থিক সঙ্কটে পড়ে যান। সেই হিসাব করে এবার লকডাউন দিলেও গ্রামের বাড়িতে না গিয়ে সিলেটে আছেন তিনি। বর্তমানে তিনি বটেশ্বর বাজারে স্যালুনে কাজ করছেন।
পলাশ বলেন, ‘কাস্টমার আগের মতো হয় না। অনেকটাই কম। দোকান তো মনে করেন খুলতেই পারি না। সকাল ৯টা বাজলে খুলি, চোর-পুলিশ চোর-পুলিশ খেলার মতো চলে। সন্ধ্যার পরে আর খোলা হয় না। পুলিশ এসে ঝামেলা করে। ধরে নিয়ে গেলে এক হাজার টাকা নেয়, তারপর ছেড়ে দেয়। আমরা এভাবেই আছি। আমাদের অবস্থা খুব শোচনীয়। এদিকে দোকানভাড়া, বাসাভাড়া, নিজেদের খরচ—আমরা খুবই দুর্ভিক্ষের মধ্যে আছি।’
তিনি বলেন, ‘কাস্টমার আগের চেয়ে অনেক কম। কাস্টমার অনেকে আসে। অনেকে ভয়ে ভয়ে আসে না। আগে প্রতিদিন দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা আয় করতে পারতাম। এখন যা আয় হয়, তা ভাড়া ও খাওয়া-দাওয়ায় চলে যায়।’
লকডাউনে ভিক্ষাবৃত্তিও তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর শাহপরান মাজারের পাশে এক তরমুজের দোকানে দেখা যায়, একজন তরমুজ কিনে টাকা দিচ্ছেন। ক্রেতার কাছ থেকে ভিক্ষা নেয়ার জন্য তিনজন ভিক্ষুক হাত পেতে আছেন।
বাংলা নিউজ এনওয়াই-এবিএ