সুনামগঞ্জে ধান কেটে ছয় ভাগ কৃষকের, এক ভাগ বেপারির
নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ এপ্রিল ২০২১, ১২:২৭ অপরাহ্ণ`শনির হাওরে আমরা ধান কাটি। আমাদের অভাবের সংসার। হাওরে আইছি বাচ্চা দুইডারে লইয়া। ২০-২২ দিন ধান কাটতে পারলে এক বছরের খানি খোরাক হইব।’ এমনটা বলছিলেন ধান কাটা শ্রমিক মধু মিয়া। তিনি তার ছেলেকে নিয়ে শনির হাওরে ধান কাটতে এসেছেন।
ধান কাটা শ্রমিকদের স্থানীয় ভাষায় বেপারি বলা হয়। প্রতিবছর সুনামগঞ্জের কৃষকদের ধান কেটে দেন লাখো বেপারি। এই বেপারি দুই রকমের। বাইরের জেলা থেকে আসা বেপারি ও আঞ্চলিক বেপারি। দুই রকমের লাখো বেপারি এখন ধান কাটায় ব্যস্ত সময় পার করছেন সুনামগঞ্জে। সবারই লক্ষ্য, এই কয়েক দিনে হাওরের কৃষকের ধান গোলায় তোলা। বিনিময়ে নিজেদেরও বছরের খাবার সংগ্রহ করা।
মধু মিয়া হলেন আঞ্চলিক বেপারি। ৩০ বছর ধরে বৈশাখ মাসে এলেই ছেলেদের নিয়ে ধান কাটায় লেগে পড়েন। তিনি তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ বাদাঘাট ইউনিয়নের বিন্নাকুলি গ্রামের বাসিন্দা। জাদুকাটা নদীতে বারকি শ্রমিক তিনি। নদীতে কাজ বন্ধ থাকায় আয়-রোজগার নেই। এতে নিজের সাত সদস্যের পরিবারে ব্যয়ভার বহন করতে হিমশিম খেতে
মধু মিয়া বলেন, আমার তিন মেয়ে ও চার ছেলে। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। অন্যরা দিনমজুরের কাজ করে। এখন সবাই ধান কাটছে। যদি ঠিকমতো ধান কাটতে পারি, তাহলে সারা বছরের খাবার বাড়ি নিয়ে যেতে পারব। বছরের নিদানকালের সময় খেয়ে বাঁচতে পারব।
মধু মিয়ার বড় ছেলে আজিজুল হক বলেন, আমি বাবার সঙ্গে ধান কাটতে এসেছি। প্রতিবছর এই সময়ে আমরা ধান কাটি। গত বছরও সারা বছরের খোরাক বাড়ি নিয়ে গেছি। ঘরে আর কিছু না থাকলেও যদি ধান থাকে, তো চিন্তা থাকে না। চারটা ভাত খেয়ে তো থাকা যায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এবার সুনামগঞ্জে ২ লাখ ২৩ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে ধান আবাদ হয়েছে। হাওর থেকে কৃষকের এই ধান তুলতে ৮ হাজার ৫০০ বেপারি বাইরের জেলা থেকে আনা হয়েছে। এ ছাড়া ১ লাখ ৮৫ হাজার আঞ্চলিক বেপারি হাওরে কাজ করছেন। এ বছর ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ ৪৪ হাজার ৫৪ মেট্রিক টন।
জানা যায়, হাওরে ধান কাটা এসব বেপারি ধানের ভাগ নিয়ে কৃষকের জমিতে ধান কাটেন। এবার কোথাও সাত ভাগ আবার কোথাও আট ভাগে ধান কাটছেন এসব বেপারি। কাটার পর মাড়াইকৃত ধানের ছয় ভাগ কৃষক নিয়ে এক ভাগ নেন বেপারি। এই নিয়মকে বলা হয় সাত ভাগ। খলা থেকে দূরের জমিতে ছয় ভাগেও ধান কাটা হচ্ছে।
বেপারি আবদুর রাজ্জাক মির বলেন, আমি হাওরে ৪০ বছর ধরে ধান কাটি। ১০ বছর ধরে ছেলেকে নিয়ে আসি। এক মাস ধান কাটতে পারলে আর চিন্তা করা লাগে না। সারা বছর পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালোভাবে চলা যায়।
বেপারি মো. বাবুল মিয়া বলেন, আমার ৫ মেয়ে ও ২ ছেলে। বড় দুই মেয়েকে অনেক কষ্ট করে বিয়ে দিয়েছি। ছোট তিন মেয়ের দুজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও এক মেয়ে মাদরাসায় পড়াশোনা করছে। আর দুই ছেলে ছোট। বর্তমানে ৭ জন মানুষ পরিবারে রয়েছে। দিনমজুরের কাজ করে পরিবার চালাতে হয়। তাও প্রতিদিন কাজ পাওয়া যায় না। এই কয়েক দিন হাওরে ধান কাটতে পারলে ছয় মাসের খাবারের ধান বাড়ি নিয়ে যেতে পারব। আর টুকটাক যা কাজ করি, তা দিয়ে বাজার-সদাই কিনলেই হবে। অন্তত বউ-সন্তানদের নিয়ে উপবাস থাকতে হবে না।
আবদুর রাজ্জাক মিরের মতো ভাগে ধান কাটছেন নূরে আলম, নজরুল ইসলাম, মিলন মিয়া, আবদুর রশিদ, আজিজুল ইসলাম আলম। তারা সবাই জানান, এই কয়েক দিনের ধান কাটার ওপর নির্ভর করবে তাদের আগামী এক বছরের খোরাক। কারণ, তাদের নিজের জমি নেই। বৈশাখের এই কয়েক দিন কৃষকের জমিতে কাজ করে খাবারের ধান সংগ্রহ করতে হয় তাদের।
জমির মালিক মো. আইয়ূব আলী বলেন, আমি সনির হাওর ষোলো কেয়ার (৩০ শতকে ১ কেয়ার) জমি করেছি। ধানও ভালো হয়েছে। এখন সাত ভাগে ১৭ জন বেপারি লাগিয়ে ধান কাটা হচ্ছে। পুরো জমির ধান কাটার পর খলায় নিয়ে মাড়াই দেব। মাড়াইয়েল পর ভাগের প্রায় ৩০ মণ ধান তারা নেবে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. ফরিদুল হাসান বলেন, সুনামগঞ্জ জেলায় হাওর এলাকায় ধান কাটতে শ্রমিকরা এক উপজেলা থেকে আরেক উপজেলায় যান। তারা সঙ্গে ছেলে মেয়ে এমনকি অনেক সময় স্ত্রীকেও নিয়ে আসেন। আবার অনেক সময় বিভিন্ন জেলা থেকে ধান কেটে দেওয়ার জন্য শ্রমিক আসেন। আমরা তাদের সহযোগিতা করি। কারণ, তারা জানেন এখানে ভাগ অনুযায়ী ফসল কাটা হয়।
তিনি বলেন, তারা যদি ২০ দিন ধান কাটতে পারেন, তাহলে তাদের পরিবারের সারা বছরের খাবারের ধান হয়ে যায়। এটা আমাদের সুনামগঞ্জের জন্য দ্রুত ধান কাটার খুব ভালো একটা নিয়ম বলে আমি মনে করি। এবার মহামারি করোনায় সারাদেশে লকডাউন থাকলেও শ্রমিকদের আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।