’অন্ধকার দিনের শেষে আলো দেখছি’
জুড়ী প্রতিনিধি (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি :
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ অক্টোবর ২০২৩, ১০:২৬ অপরাহ্ণমৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ফুলতলা চা বাগানের এলবিনটিলা ডিভিশনে বেড়ে উঠা এক অদম্য তরুণ অঞ্জন ভূমিজ। এই ‘অঞ্জন ভূমিজ’ই ভূমিজ সম্প্রদায়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট । টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী শেষ করার পেছনে রয়েছে দারিদ্রের কাছে তার হার না মানার এক অনন্য গল্প। তার বাবা অমৃত ভূমিজ এবং মা রতনমনি ভূমিজও ফুলতলা চা বাগানের এলবিনটিলা ডিভিশনের একজন চা শ্রমিক। বাবা-মা উভয়ের মাসিক আয় সর্বসাকুল্যে হাজার বিশের চেয়েও কম। তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে তাদের পাঁচজনের সংসার।
মুলত সংসারে সবার বড় অঞ্জন। পদার্থবিজ্ঞানে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেছেন। ভূমিজদের প্রথম সন্তান হিসেবে তিনিই চা বাগানের গন্ডি পেরিয়ে পড়ছেন উচ্চশিক্ষা অঙ্গনে। তার ছোটবোন অঞ্জলি পড়ছেন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন চট্টগ্রাম-এ । আরেক ছোটবোন উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা করছেন। অঞ্জন ছোটবেলায় স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথাও কখনো ভাবেননি। পড়ালেখার প্রতি সেই ছোটবেলা থেকে অদম্য ইচ্ছা থাকলে, কষ্টের কষাঘাতে জর্জরিত জীবন আর তাকে পড়ালেখা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা পারেনি।
অঞ্জন ভূমিজ জানান, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একসময় স্বপ্নের মতো মনে হতো। স্নাতক শেষ করে ভালোই লাগছে। মনে হচ্ছে, অন্ধকার দিনের শেষে আলো দেখছি।
অঞ্জন আরো বলেন, ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি চা বাগানে যারা কাজ করে সব পরিবারই দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করেন।চা বাগানে শিক্ষিতের হার নেই বললেই চলে। বাগানে কারোরই আর্থিক অবস্থা ভালো থাকে না। অর্থ সংকটের কারণে চা বাগানে ঝরে পড়ার প্রবনতা বেশি। এটা দেখে খুব খারাপ লাগত। এখন আমি চা বাগানের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার জন্য অনুপ্রেরণা দেই, যাতে তারা আরো সামনে দিকে অগ্রসর হয়।
এক সময় আমার চা শ্রমিক বাবা বলতেন পড়ালেখা করে কি হবি, চা শ্রমিকের সন্তান চা বাগানেই থাকবি, পাতি তুলবি- এসব কথা এক সময় কষ্ট দিলেও, সেই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি। ছোটবেলা থেকে ইচ্ছা ছিল উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হব। গরিব হওয়াটা পথের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আমার প্রবল ইচ্ছা শক্তিতে আজ অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছেছি। অভাব অনটনের কারণে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজ করেছি। ছুটির সময় বেশি করে কাজ করতাম। পড়ালেখার পাশাপাশি মায়ের সঙ্গে খাসিয়া পুঞ্জিতে দিনমজুরের কাজ করি। আত্মবিশ্বাসের কারণে প্রতিকূল পরিবেশেও পড়ালেখা থামেনি। ঈদ-পূজাসহ অন্যান্য ছুটিতে পুঞ্জিতে কাজ করে পড়ার খরচ যুগিয়েছি। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ কমানোর আশায় ছুটি পেলেই বাড়ি এসে পুঞ্জির কাজে চলে যেতাম। সে আয় দিয়েই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ মেটাচ্ছি।
এক সময় বাবা গরু বিক্রি, মহাজন, এনজিও থেকে লোন এনে আমাকে পড়ালেখার টাকা দিতেন। তিনি এই ঋণের বোঝা টেনেছেন দিনের পর দিন। তাকে যেন আর এমন কিছুই না করতে হয় সে জন্য সবসময় কাজ খুঁজি। বাড়িতে গেলেই কারো ধান কেটে দেই, কোদাল দিয়ে মাটি কাটি, ধান রোপণ করি। কাজ না পেলে পুঞ্জিতে চলে যাই। তখন কিছু আয় হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকলে রুমে রুমে খাবার ডেলিভারি দিই। প্রতিদিন ৫০-১০০ টাকা পাই।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চা বাগানের সংস্কৃতি আমাকে অনেক বেশি টানে। আমি আমার সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য-ইতিহাস সবাইকে জানাতে চাই। স্নাতকে ভর্তি হওয়ার পেছনেও আছে এক ইতিহাস। টাকা কর্জ করে কোচিং এ ভর্তি হয়েও প্রথমবার সুযোগ পাইনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। তখন আমার বাবা আমাকে শক্তি জুগিয়েছেন। উৎসাহ দিয়েছেন। দ্বিতীয়বারের প্রচেষ্টায় আমি স্নাতকে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। কোটায় প্রথম হয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তিও হয়েছিলাম অনেক স্বপ্ন দেখে। পড়ালেখা শেষ করে একজন প্রকৃত শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম। শিক্ষাজীবনে নিজের দরিদ্রতার পরিচয়ে অনেক শিক্ষক আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিলেন। বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সুযোগ পর্যন্ত দিতে চাননি তারা। আমি চেয়েছিলাম নিজে শিক্ষক হয়ে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পড়াব। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েও যখন ভর্তি হতে পারছিলাম না, তখনকার প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. সিরাজুল ইসলাম আমাকে ভর্তির অর্থ জোগাড় করে দিয়েছিলেন শিক্ষকদের কাছ থেকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সহায়তা করেছিলেন। এমনকি নিজ বিভাগের ব্যাচমেট বন্ধুরা আমার ড্রেস, বই কিনে দিয়েছিল। তাদের অবদান আমার সবসময় মনে থাকবে। বর্তমানে চলছি এক বড় ভাইয়ের সহায়তায়। তিনি আমাকে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা দেন। অন্য একজন বড় ভাইও আমাকে সাহায্য করেন। প্রথমদিকে টিউশনি করিয়ে চললেও, যখন তারা জানতে পারত আমি ভূমিজ সম্প্রদায়ের- আমার টিউশনগুলো আর থাকত না। অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম তখন। আমি আরো পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চাই, আমার আর্থিক সামর্থ থাকলে আমি ডাটা সায়েন্সে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করবো।