দুর্গাপূজার মাধ্যমে নারীর ভূমিকাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে
নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ অক্টোবর ২০২০, ৪:২২ অপরাহ্ণবাংলা বছর ঘুরে আবার এসছে বা শুরু হবে এখন প্রস্তুতি হচ্ছে বাঙালির প্রাণের উৎসব, দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজা মানেই সার্বজনীন উৎসব, দেবী দুর্গা আমাদের মাঝে মাতৃরূপে বিরাজ করেন, সবার মা। মা সন্তানের সুরক্ষাদায়িনী, সব অপশক্তি বিনাশিনী, মুক্তিদায়িনী, আনন্দময়ী দুর্গা। মায়ের কাছে সব সন্তান সমান, সব সন্তানের কাছে মা অনন্য, তাই মা দুর্গা সর্বজনের, দুর্গাপূজা সার্বজনীন।
বাঙালি চিরকালই উৎসবপ্রেমী জাতি। লোকমুখে প্রচলিত “বাংলার মানুষের বারো মাসে তেরো পার্বণ” কথাটি মোটেই অত্যুক্তি নয়। সারা বছর জুড়েই বাঙালির জীবন নানা প্রকার উৎসবের আলোয় মুখরিত হয়ে থাকে। তবে এত সব উৎসবের মধ্যেও যেটি বাঙালির কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় এবং অন্তরের উৎসব তথা বাঙালি জাতির সার্বজনীন, তা হল শরৎকালের দুর্গোৎসব।
বলা যায় বাঙালি জাতির সমগ্র প্রাণ এই পূজার মধ্যে নিহিত থাকে। বর্ষার কালো মেঘ সরিয়ে শরতের রোদ্দুর উকি দিলেই বাঙালির মন হিসেব কষতে শুরু করে দেয় মা দুর্গার আগমনের আর কতদিন বাকি। প্রতিদিনকার পরিচিত গতানুগতিক জীবনে ব্যাস্ত বাঙালি গোটা একটা বছর শত উৎসবের মধ্যেও অধীরভাবে প্রতীক্ষা করে থাকে এই মহোৎসবের জন্য।
শরৎকালে এই উৎসব হয় বলে এটি শারদোৎসব নামেও পরিচিত। ধনী গরীব,নর-নারী, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নির্বিশেষে সকল মানুষের মিলনের এমন সার্বজনীন ভাবটি অন্য আর কোনো উৎসবে সেভাবে দেখা যায়না। সমগ্র দেশ তথা পৃথিবীর কাছে বাঙালি জাতির এই দুর্গাপূজার রূপ অভাবনীয় এবং অভিনব।
দুর্গা পূজা কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল তা ঠিক করে বলা যায় না। দুর্গাপূজার ইতিহাস সুদীর্ঘকালের। হিন্দু পুরাণে দুর্গাপূজার সূচনা সম্পর্কে বিভিন্ন কাহিনী পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে কোথাও কোথাও কথিত আছে, পুরাকালে রাজা সুরথ তার হারিয়ে যাওয়া রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য দেবী দুর্গার পূজা করেন। তখন এই পূজা হতো বসন্ত কালে। সেজন্য এই পূজাকে বাসন্তী পূজা বলা হত।
মাহাত্ম্যরকথা যদি বলি তাহলে বলবো : শুধু যে ধর্মীয় গুরুত্বেই জগন্মাতা দুর্গার আরাধনা বাঙালী হিন্দুর জীবনে প্রধানতম স্থান গ্রহণ করেছে তাই নয়, মানবিক সম্পর্কের সহজ আন্তরিকতার স্পশে এ উৎসবটি অনন্য। হিমালয়-দুহিতা উমা পুত্র-কন্যা সঙ্গে নিয়ে মাত্র তিনটি দিনের জন্য পিতৃগৃহে ফিরে আসেন, চতুর্থ দিনেই আবার মাতা মেনকাকে অশ্রু সাগরে ভাসিয়ে স্বামী মহেশ্বরের আলয়ে প্রত্যাবর্তন করেন ।
শারদোৎসব প্রকৃতপক্ষে বাংলার পারিবারিক জীবনে মিলনােৎসবের মাধুর্য নিয়েই আবির্ভূত হয়। সুদীর্ঘে প্রবাসজীবনযাপন করে প্রিয়জন ফিরে আসে জননীর স্নেহাঞ্চলতলে, আনন্দ-হাসিতে মুখর হয় বাঙালীর গৃহ-প্রাঙ্গণ। ধরাতলে রচিত হয় গিরীশ মেনকার সুখতৃপ্ত সংসারের দ্বিতীয় রূপ। তাই বাঙালীই নিঃসঙ্কোচ সারল্যে বলতে পেরেছে-‘দেবতারে মােরা আত্মীয় জানি।
দুর্গোৎসব বা দুর্গাপূজা জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতায় বাংলার অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। দুর্গোৎসব নিয়ে আসে বাংলার জীবনে এক নতুন মাত্রা, বাংলার মানুষ মেতে উঠে খুশিতে আনন্দে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের খুব কম উৎসবের সঙ্গেই তার তুলনা চলে। যদিও এটি মূলত: ধর্মীয় অনুষ্ঠান তবুও সকল শ্রেণীর জনসাধারণের আন্তরিক মিলনের ফলে এক উদারতর সামাজিক ব্যপ্তি লাভ করেছে। সর্বমানবের মিলনই যদি জাতীয় উৎসবের বৈশিষ্ট্য হয়, তবে দুর্গোৎসবকে নিঃসন্দেহে বাংলা ও বাঙালী জাতির জাতীয় উৎসবরূপে স্বীকার করতে হবে।
দুর্গাপূজার মাধ্যমে বাংলা সংস্কৃতিতে নারীর ভূমিকাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, দুর্গাকে মাতৃরূপে বর্ণনার মাধ্যমে প্রথমত নারীর চিরন্তন মাতৃরূপকে মূল্যায়ন করা হয়েছে, দুর্গা কর্তৃক মহিষাসুর বধের মাধ্যমে নারীকে মহাশক্তির আধার রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। দুর্গাকে বলা হয়েছে সৃষ্টির প্রতীক, সমৃদ্ধির প্রতীক, সুরক্ষার প্রতীক, হিন্দু মিথলজিতে দুর্গার আদলেই নারীকে চিত্রিত করা হয়েছে। নারী সৃষ্টির প্রতীক, নারী সন্তান জন্ম দেয়, সন্তানের মুখে আহার তুলে দেয়, সন্তানকে প্রতিকূলতা থেকে সুরক্ষা করে, নারী সংসার গড়ে, সমাজ গড়ে, সমাজ-সংসারকে সব বিপদ-আপদ থেকে রক্ষাও করে, নারী বিপন্নকে আশ্রয় দেয়, নিরন্নকে অন্ন দান করে, এভাবেই নারী হয়ে ওঠে দুর্গার প্রতিমূর্তি।
দুর্গাপূজা মূলত দশ দিনের উৎসব। শুরু হয় দেবীপক্ষে, শুরুর পর্বের নাম ‘মহালয়া’, মহালয়াতে দেবী দুর্গাকে পিত্রালয়ে আবাহন জানানো হয়। মহালয়ার পরের দিন দ্বিতীয়া, এভাবেই তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এবং দশমী। এ দশ দিনের মধ্যে মহালয়া এবং সপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী এবং দশমী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যাইহোক ভারতীয় উপমহাদেশে সেই প্রাচীন যুগ থেকে নানারূপে দেবী দুর্গার আরাধনা হয়ে আসছে। বাঙালিরা এরমধ্যে মূলত কৃত্তিবাসী রামায়ণ বর্ণিত শ্রী রামচন্দ্রের অকালবোধনকেই নিজেদের শারদোৎসব হিসেবে বেছে নিয়েছে।
দুর্গা মায়ের আগমনের বাণী ঘোষণা করেই যেনো প্রকৃতি সেজে ওঠে এক অভিনব সজ্জায়। কোন এক প্রাচীন যুগে হয়ত এমনই মনোরম পরিবেশে সকল বিপত্তির অবসানের উদ্দেশ্যে শরৎকালে দেবী দুর্গার অকালবোধনের আয়োজন করেছিলেন শ্রী রামচন্দ্র। বাঙালি প্রতি শরৎ ঋতুতে মা দুর্গার বোধন করে সেই ঐতিহ্যকে আজও বহন করে নিয়ে চলেছে।
বাঙালিরা যে যেখানেই থাকুক না কেন এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সকলেই আনন্দে মেতে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইংল্যান্ডের নানা শহরেও বসবাসকারী প্রবাসী বাঙ্গালীদের আয়োজিত দুর্গাপূজাগুলি বিশ্বজুড়ে আলোচনার শীর্ষে থাকে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশে দুর্গোৎসব উপলক্ষে সরকারি ছুটি দেওয়া হয়ে থাকে।
সমগ্র উপমহাদেশজুড়ে প্রচলিত হলেও বাঙালির কাছে দুর্গাপূজার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তথা সামাজিক গুরুত্ব অনেকটাই আলাদা। শাস্ত্রীয় দুর্গাপূজা বাঙালির কাছে প্রাণের প্রিয় শারদ উৎসব। সাধারণতঃ আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে বাঙালির এই উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। সেই শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত দেবীর আরাধনা চলে।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, কলামিষ্ট ও রাজনীতিবিদ।