ভাষা একটি জাতির প্রতিচ্ছবি:হাসিনা রুমী
নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ২:৩৫ অপরাহ্ণচেতনা, অনুপ্রেরণা ,অহংকার সব বিশ্লেষণই ঘিরে রেখেছেএকুশের বিশালতাকে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস প্রকৃতপক্ষেই জাতি হিসেবে বাঙ্গালির অস্তিত্বের অনুভূতির সূচনা। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ এ ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয় পাকিস্তান ও ভারত নামক স্বাধীন দুটি রাষ্ট্রে। পাকিস্তানের দুটি অংশের একটি ছিল পূর্ব বাংলা । বর্তমান পাকিস্তান হতে দুই হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত বর্তমান বাংলাদেশ। সুতরাং একটি দেশের দুই অংশের ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মৌলিক পার্থক্য ছিল চোখে পড়ার মতো বিস্তর।
এত অধিক পরিমান দূরত্বের একটি দেশের দুটি অংশ পৃথিবীতে বিরল ঘটনা।তার উপর মাৎস্য ন্যায় পদ্ধতিতে এক অংশ যখন নিজেদের সবল এবং সর্বসেরা ভেবে নিয়ে অপর অংশের উপর চালিয়ে যেতে থাকে অবিরাম অবিচার, অত্যাচার, জুলুম, বঞ্ছিতকরন, নিগৃহীতকরণ, ঠকানো সহ সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বস্তুত সেই কঠিন বাস্তবতা থেকেইই জন্ম নেয় বাঙ্গালির ক্ষোভ, ঘৃণা ওপাল্টা জবাবের সাহসিকতা।
পুঞ্জিবিত হতে থাকে বীরত্বের সাথেলড়াই করার মানসিকতা। ১৯৫২র একুশে ফেব্রুয়ারি মূলত বাঙ্গালীরআত্ম চেতনা রক্ষারনিমিত্তে এক ভয়ঙ্কর স্ফুলিঙ্গের বিচ্ছুরণ আর ভাষার দাবীতে আত্মত্যাগের দৃঢ় সঙ্কল্পের বাসনা, যারফসল স্বরূপ আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নেরবীজ বপনের মাহেন্দ্রক্ষনের প্রাপ্তি আর বিশ্বময় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সফল স্বীকৃতিলাভ।
প্রত্যেক জাতিরই আলাদা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এমনকি একই রাষ্ট্রে রয়েছে বহু ভাষার প্রচলন। ভাষা কেবলই ভাব প্রকাশের মৌখিক একটি মাধ্যম নয়, ভাষা একটি জাতির প্রতিচ্ছবি। নিজস্ব ইতিহাস, স্বকীয়তা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি,মনন, মানুষের আচরণ ও উদ্দীপনার বহিঃপ্রকাশের দর্পণতার নিজের ভাষা। মাতৃ সান্নিধ্যে জন্মলগ্ন থেকে আমরা যেভাবে মনের গভীর থেকে গভীরতম আবেগ, অনুভূতি, ভালবাসা, প্রত্যয় প্রকাশ করি তাই মাতৃভাষা।
যা কখনোই কিছু শব্দ আর অলঙ্করণের সমারোহ নয়। এ কারণে কারো মায়ের ভাষা কেঁড়ে নেয়ার অন্তর্নিহিত অর্থ দাঁড়ায় তার আত্মাকে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করার অপপ্রয়াস।আমরা কথা বলি জিহ্বা ও মুখের দ্বারা কিন্ততার উদ্রেক হয় হৃদয়ের অন্তঃস্থল হতে। কোন ভাষাকে নিঃশেষ, নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা মানে একটি জাতির ইতিহাস, সভ্যতা ও কৃষ্টিকে ধ্বংস করাই নয় আদতে পুরো জাতিটাকেই হত্যা করার শামিল। প্রত্যেকেই ভীষণভাবে স্পর্শকাতর তার নিজের ভাষার প্রতি। ভালবাসার নিদারুন বিশালতার নামান্তরইমাতৃভাষা।
একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা ও শহীদ দিবস রূপে পালিত হতো ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে।
এরপর ইউনেস্কো কর্তৃক ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি জ্ঞাপন বাংলাদেশ সহ সারা পৃথিবীতে এক নতুন মাত্রার সংযোজন, যা ৫২’র মহান ইতিহাসকে করে তুলেছে আরো গৌরবজ্জল। এই সাফল্যের অংশীদার হতে পেরে আমরা প্রতিটি বাঙ্গালীই গর্বিত। ১৯৯৮ সালে কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম সর্বপ্রথম তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব কাফি আনানের কাছে চিঠি লিখেন যে, পৃথিবীর সকল ভাষা সংরক্ষণকরণ ও আন্তর্জাতিকভাবে একটি দিনকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করারবিষয়ে।দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর দেখা যায় ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিই সারা পৃথিবীর ভাষার ইতিহাসে একটিউল্লেখযোগ্য বিশেষ দিন এবং একমাত্র আন্দোলন যেখানে বাঙ্গালী জাতি জীবন উৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে বাংলাকে তাদের রাষ্ট্র ভাষাহিসেবে।
কোন বাঁধাই এমনকি বুলেট বন্দুকের ভয়ও রুখতে পারেনিবাংলার আবাল বৃদ্ধ বনিতা সহ নারী পুরুষ সকলকে সেই দিন।১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর পরিশেষে ২১শে ফেব্রুয়ারিই নির্ধারিত হয় আন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে যা দুনিয়াজুড়ে বর্তমান কালেবাৎসরিক ভিত্তিতে পালিত হয়ে আসছে যথাযথ মর্যাদা আর গভীর শ্রদ্ধার সাথে। একুশে ফেব্রুয়েরি এখন শুধুমাত্র বাঙ্গালীরই দিন নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীকে সাথে নিয়ে আমরা ভাগ করে নিয়েছি বাংলা ভাষার জন্য আমাদের আত্মত্যাগের মহিমা ও অর্জনের সুখ। ভাষা শহীদসালাম,বরকত,রফিক,জব্বার, শফিক আউয়াল সহ নাম না জানা প্রত্যেকের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা, হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা এবং সৃষ্টিকর্তার নিকট সর্বোত্তম প্রার্থনাথাকে সব সময়ের জন্য। যাঁদের জীবনের মূল্যে আজ আমরা গর্বিত বাংলা ভাষাভাষী।
শুধুমাত্র গুটিকয়েক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিনটিকে সীমাবদ্ধ না করে নতুন প্রজন্ম সহ আমাদের সকলের প্রয়োজন ভাষা আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ ও প্রকৃত ইতিহাস জানার চেষ্টা অব্যহত রাখা,পরিশুদ্ধ বাংলার চর্চা করা। অতুলপ্রসাদ সেনের কবিতার কি দারুন চয়ন,‘মোদের গরব মোদের আশা আ’মরি বাংলা ভাষা’। বস্তুত,এ এমনি এক চেতনা যা আমাদের আলোকিত করে প্রতিনিয়ত,বিশ্ববাসীর সম্মুখে আমার পরিচয় বহন করে একজন গর্বিত বাঙ্গালীর, আর স্মরণ করিয়ে দেয় একুশের হাত ধরেই আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুত্থান ও সমৃদ্ধির পথচলা। সার্থক জনম আমার এই দেশেতে জন্মে,বাংলাদেশ আমার প্রিয় মাতৃভূমি, প্রিয় জন্মভূমি।
লেখক :সমাজকর্মী