বিচারব্যবস্থায় বাংলা ভাষার প্রাসঙ্গিকতা এবং স্বীকৃতি
নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১:৪৩ অপরাহ্ণপ্রাচীনকালে ভারতে সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষা বিচারে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে ফার্সি। এরও পরে ফার্সির সাথে বাংলা।সময়ের প্রয়োজনে ১৭৯৭তে আইন, বিধি, অধ্যাদেশ এবং প্রবিধান বাংলা ভাষায় ভাষান্তর হয়।১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ০৪মে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় আইনের ব্যবহার শুরু হয়।শুরুর পর চলতে থাকে।অগ্রসর হতে থাকে।একপর্যায়ে জেলা আদালতে ফার্সির বদলে বাংলা জনপ্রিয়তা পায়। ব্রিটিশ শাসকরা ১৮৩৫ সনে ঘোষণা দিয়ে ফার্সিকে বাদ দিয়ে ইংরেজিকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ফলে ব্রিটিশ শাসনামলে আদালতে ইংরেজির ব্যবহার চালু হয়ে আজও বিদ্যমান রয়েছে। উপমহাদেশে ১৭৭৪ সনে কলকাতা সুপ্রিমকোর্ট প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতায় আজকের এই বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট। ঔপনিবেশিক ভাষা ইংরেজি। মূলত তাদের স্বার্থেই বিচারব্যবস্থায় ইংরেজি ভাষার প্রচলন ও ব্যবহার।ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য আজ অবধি আছে।বলতে হয় শোষণের হাতিয়ার হিসেবেই আছে।স্বাধীন সার্বভৌম দেশে এমনটি মেনে নেয়া যায় না। চাপিয়ে দেয়া ঔপনিবেশিক এই ভাষা আদালত আঙ্গিনা থেকে উচ্ছেদ জরুরি।মাতৃভাষা ছাড়া কাঙ্খিত সুবিচার নিশ্চিত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়;হতে পারে না।সময়ের বিবর্তনে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার নিমিত্ত আদালতে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
দুই.
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ।গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সনের ০৪ নভেম্বর রচিত হয়ে কার্যকর হয় ১৬ ডিসেম্বরে। সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। বাংলাদেশ সংবিধানের সাধারণ ঘোষণা: প্রজাতন্ত্রের ‘রাষ্ট্রভাষা’ বাংলা। একথা বাংলাদেশের সংবিধানের সাত অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। আইনকে মানতে রাষ্ট্রের নাগরিক বাধ্য।ধরে নেওয়া হয় রাষ্ট্রের সকলেই আইন জানেন।না জানার কোনো অজুহাত কেউ দাবি করতে পারবে না। বাংলাদেশ সংবিধান পৃথিবীর একমাত্র বাংলা ভাষার সংবিধান। এই বাংলা ভাষার জন্যে জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে ১৯৫২তে।রক্তের বিনিময়ে অর্জিত প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা।পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষার তরে বাঙালির এ জীবনদান এক বিরল ঘটনা।অভূতপূর্ব,যা একদিকে বেদনার;অন্যদিকে গৌরবেরও। এর ফলেই ১৯৫৬ সনে সংবিধানে বাংলা ভাষাকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ করার দাবি আংশিকভাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের ১৯৬২ সনের সংবিধানের ২১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দু, দুই ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসেবে শর্তারোপক্রমে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। একসময় ১৯৬৭ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির সাথে বাংলাকেও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিলো। ফলে আইন কলেজেও বাংলা শুরু হয়। বাস্তব একটি উদাহরণ রয়েছে-'আসামী জুয়েল শিকদার নামক রিক্সা ড্রাইভারকে তাঁর রিক্সা সীটের নীচে ৫০ বোতল ভারতীয় ফেনসিডিল পাওয়ার জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বিচারান্তে ১৯৭৪ সনের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫বি ধারায় দোষীসাব্যস্থ করে ০৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ০১ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো ০৪ মাসের কারাদণ্ড প্রদান করেন।বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩০ ধারার বিধান অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের রায় ও আদেশের বিরুদ্ধে নির্ধারিত সময়ে আপিল দায়ের না হলে ১৯০৮ সনের তামাদি আইনের ০৫ ধারার বিধান প্রয়োগে আপিল দায়েরে কোনো সুযোগ থাকে না।এই মোয়াক্কেল পেয়ে হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী রায়কে case of no evidence উল্লেখে ১৮৯৮ সনের ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১এ ধারার বিধানানুযায়ী কোয়াশ (quash) করণের জন্যে একটি ফৌজদারি বিবিধ মামলা করে রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জুয়েল শিকদারের জামিন করিয়ে নেন।চুড়ান্ত শুনানীকালে জুয়েল শিকদারের আইনজীবী সাহেব পাওয়া যায় নি।মামলাটি মেরিট অনুযায়ী শুনানীশেষে বৈচারিক ট্রাইব্যুনালের রায়কে একটি উৎকৃষ্ট রায় বলে অভিহিত করে রুল ডিসচার্জ করা হয়।রায় বহাল থাকে।বিচারপতিগণ আক্ষেপ করে লিখেন যে,দরখাস্তকারী-দণ্ডিত ব্যক্তির বোধগম্য ভাষায় যদি দণ্ডদান করা হতো তাহলে সে নিজেই সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ বুঝতে পারতো এবং অকারণে বাঙালকে আর হাইকোর্ট দেখানো সম্ভব হতো না।ভাষার কারণে বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানোর প্রবণতা রয়ে গেছে।অবোধগম্য ভাষায় বিচারের রায় প্রচারের কারণে বাঙাল শোষিত হচ্ছে।সংবিধানের আলোকে যে জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক সে জনগণই হচ্ছে শোষিত(০৩ এএলআর,১৩২)।শোষণের এই অবশেষ দূর করা অসম্ভব নয়। প্রয়োজন ভাবনার,সদিচ্ছার ও মানসিকতার।
তিন.
ভাষা হতে স্বাধীনতা। মূলত স্বাধীনতার বীজ রোপন হয়েছিল ৫২’র ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত অগ্নিগর্ভে। রক্তদানের মধ্য দিয়েই একাত্তরে জনযুদ্ধে ত্রিশলক্ষ জীবন উৎসর্গ ও দুইলক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে স্বাধীন প্রিয় বাংলাদেশ। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা প্রদান করেছে। ফলে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, স্বাধীনতার পর সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদ এর অধীনে প্রণয়ন করা হলেও এর বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। প্রণীত বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের ৩(১) ধারায় স্পষ্টত বলা হয়েছে, “এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে। এই ধারা মোতাবেক কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে”।
চার.
দেওয়ানি কার্যবিধি ১৯০৮ সনের ০৫ নম্বর আইন কার্যকর হয় ১৯০৯ সনের ০১ জানুয়ারি। এই আইনের ১৮ নম্বর আদেশের ০৪,০৫ এবং ০৬ নম্বর নিয়মে সাক্ষীর জবানবন্দীর ভাষা সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে- ‘বিচারকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সাক্ষীর জবানবন্দী আদালতের ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে হবে। কোনো সাক্ষীর জবানবন্দী সমাপ্ত হলে তা বিচারককে সাক্ষীর সামনে পাঠ করে শোনাতে হবে। ০৬ নম্বর নিয়মে বলা হয়েছে, যে ক্ষেত্রে সাক্ষীর জবানবন্দী তার ব্যবহৃত ভাষা ব্যতীত অপর কোনো ভাষায় লিপিবদ্ধ করা হয়, তা যদি সাক্ষীর বোধগম্য না হয়, তবে লিপিবদ্ধ জবানবন্দী সাক্ষীর ব্যবহৃত ভাষায় তরজমা করে শোনাতে হবে। এ
থেকে বোঝা যায়, দেওয়ানি কার্যবিধির শুরু থেকেই সাক্ষ্যগ্রহণ মাতৃভাষায় আদালতে হচ্ছে। ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮, দণ্ডবিধি,১৮৬০ এবং সাক্ষ্য আইন,১৮৭২ সালে প্রণীত।১৮৯৮ সনের ফৌজদারি আইনের ৩৬৪ ধারায় জবানবন্দী প্রদানকারীর স্বীয় ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে হবে উল্লেখ আছে।তদ্রুপ ১৮৭২ সনের সাক্ষ্য আইনের ২৪ ধারায় স্বীকারোক্তি, ৩২ ধারায় মৃত্যুকালীন ঘোষণা প্রদানকারীর ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে হবে। না হলে জবানবন্দী অনেকটা মূল্যহীন।
পাঁচ.
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইনসভার কার্যক্রম বাংলায় পরিচালিত হলেও আদালতে চলছে ভিনদেশের ভাষা ইংরেজির ব্যবহার। বাংলায় মামলা-মোকদ্দমা দায়ের, সাক্ষ্যগ্রহণ, যুক্তিতর্ক, রায় এবং আদেশ হলে বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী, বিচারক উপকৃত হবেন একথা বোঝতে পণ্ডিত হওয়া লাগবে না; আমজনতাই যথেষ্ট। দেশের ভাষা বাংলা, বিচারপ্রার্থীদের ভাষা বাংলা, বিচারকগণ ও বিচার কাজে নিয়োজিত সকলেই বাঙালি এবং ভাষা বাংলা। তাহলে কেন আদালতে ভাষা কিংবা বিচার কার্যক্রম বাংলা ভাষাতে হবে না? এ এক সহজ প্রশ্ন। উত্তর হচ্ছে তথাকথিত সংখ্যালঘিষ্ঠ অভিজাত শ্রেণির কায়েমি স্বার্থ রক্ষা।
ছয়.
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইন বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগ সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের বিধান ও ১৯৮৭ সালের আইনের বিধান অনুসরণ করছে। নিম্ন আদালতেও অনুসরণ করা শুরু হয়েছিলো। হাশমত উল্লাহ বনাম আজমিরি বিবি ও অন্যান্য মামলায় ৪৪ নম্বর 'ঢাকা ল’ রিপোর্ট' জার্নালে ৩৩২-৩৩৮ পৃষ্ঠার অনুচ্ছেদ ২০এ প্রকাশিত হাইকোর্ট বিভাগ রায় দিয়েছেন যে, সরকার দেওয়ানি নিম্ন আদালতের ভাষার ব্যাপারে দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭(২) ধারায় কোনো ঘোষণা দেয়নি বিধায় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করা সত্ত্বেও অধঃস্তন দেওয়ানি আদালতের কার্যক্রম ইংরেজি ভাষায় চলমান রাখা যাবে। যে কারণে আজ অবধি বিচার কাজে বাংলা ভাষা পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হয়নি। হচ্ছেও না, কবে হবে এরও কোনো দারাদিশা নেই। এছাড়াও অনুরূপ বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫৮ ধারায়ও সাদৃশ্য বিধান বিদ্যমান রয়েছে। ফলে আদালতে বাংলার ব্যবহার কার্যকর করতে দু’আইনের সংশ্লিষ্ট বিধানদ্বয় পরিবর্তন করা অপরিহার্য ও জরুরি। আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার চালু করার ক্ষেত্রে প্রকৃত বাধা মনে হয় মনস্তাত্ত্বিক। সরকার আদালতের ভাষা বাংলা ঘোষণাপত্র জারি করার মাধ্যমে কার্যকর করতে পারে। সরকারের ইচ্ছাই যথেষ্ট।
সাত.
রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত প্রায় ৮০০টি আইনের মধ্যে গত ১৪ বছরে সবেমাত্র ১০৭টি আইন বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সশস্ত্র বাহিনীর ৪০টি আইন এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ৬৫টি আইন বাংলায় অনুবাদের কাজ চলমান আছে।গত ২০০৭ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ কোডে ১৮৩৬ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ২৬ খণ্ড এবং ১৯৮৭ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ১২ খণ্ডসহ মোট ৯৫৫টি আইনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।তন্মধ্যে ২৬ খণ্ডের ৭৫০টি আইন ইংরেজি ভাষায় লেখা। এসব আইনের মধ্যে মাত্র ১০০টির মতো আইন ১৪ বছরে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।
আট.
বাংলা ভাষায় পৃথিবীর প্রায় ৩০ কোটি লোক কথা বলে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ১১টি নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তা ব্যতীত শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ বাংলা বলে। পৃথিবীতে ৮ হাজারের মতো ভাষা রয়েছে, মায়ের ভাষা বিবেচনায় বাংলা চতুর্থ স্থানে, ভাষিক বিবেচনায় সপ্তমে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের সংবিধানে ৮ম তপসিলে ১৮টি তালিকাবদ্ধ ভাষার মধ্যে অন্যতম ভাষা বাংলা। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগে ও ইমিগ্রেশনের ওয়েবসাইটে বাংলা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের হিথরো বিমানবন্দরে বাংলায় ঘোষণা দেওয়া হয়। বিবিসি, ভয়েজ অব আমেরিকা, ডয়েস ভেল, রেডিও জাপান, চীন আন্তর্জাতিক বেতার থেকে বাংলায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়ে থাকে। কানাডাতে রেডিও চ্যানেলে রেডিও মেট্রো বাংলায় প্রচার হয়। বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাউথ এশিয়ানস ল্যাংগুয়েজ স্টাডিস বিভাগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয়। গ্রেটব্রিটেন, আমেরিকা ও ইউরোপের দেশসমূহ থেকে বাংলা ভাষায় পত্রিকা প্রকাশিত ও প্রচারিত হচ্ছে। তাছাড়াও অনলাইন পত্রিকাসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন পরিসরে বাংলার ব্যাপক ব্যবহার নিত্যদিন অহরহ ক্রমবর্ধমান হারে ক্রমবিকাশ হচ্ছে। বাংলাদেশে আইনও প্রণীত হচ্ছে বাংলায়। তদুপরি কোন কায়েমি স্বার্থে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা আদৌ সম্ভব হচ্ছে না? গুটিকয়েক লোকের জন্যে তো বিচার ব্যবস্থা নয়। অনুধাবন করতে হবে, বুঝতে এবং বোঝাতেও হবে। গণমানুষের সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে নিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এই আওয়াজ ক্ষীণ! ম্রিয়মাণ! যতদিন আওয়াজ মসনদে কাঁপন ধরাতে পারবে না, ততদিন এই দাবি হয়তো প্রলম্বিত হতেই থাকবে।
নয়.
বিচারপ্রার্থীদের ভাষায় বিচার কার্যক্রম পরিচালিত না হলে, তা কোনোভাবেই ন্যায়বিচার হতে পারে না। একারণেই জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল কোভেনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিকেল রাইট-এ উল্লেখ রয়েছে, বিচারপ্রার্থীদের বোধগম্য ভাষায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বোধগম্য না হলে, দোভাষীর ব্যবস্থা করতে হবে। ইহা তাঁর মানবাধিকার। বাংলাদেশে এর সুস্পষ্ট ব্যত্যয় হচ্ছে। দেশের শিক্ষিতজনদের কিছুসংখ্যক লোকের নিকট ইংরেজি বোধগম্য, প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণের বোধগম্য নয়। যা জনগণের সাথে এক ধরণের পরিহাস। বাংলাদেশে বিচারপ্রার্থী, বিচারক, আইনজীবী, আদালতে সংশ্লিষ্ট প্রায় সকলেই বাঙালি ও বাংলা ভাষা জানা লোক। আদালতে বাংলা ভাষা ছাড়া পরদেশী ভাষা ব্যবহৃত হবে, যুগের পর যুগ মেনে নেওয়া যায় না। যা স্বাধীন দেশের জন্যে সত্যিকার অর্থে অবমাননাকর। দেশের আদালতে জনগণের ভাষা ব্যবহার না হওয়া মানে এক ধরনের অপমানের বিষয় নয় কি? এর জবাব চাইতে হবে, দাবি উত্থাপন করতে হবে।
দশ.
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সামান্য কয়েক দিন পূর্বে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির একুশে অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমান এক ভাষণে বলেন- ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতেরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তার পরে বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদেরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সেই বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ ঘোষণা দেন, ‘বাংলা হবে দেশের সরকারি ভাষা’। কিন্তু স্বাধীনতার এতবছর পরও তা হয়নি।
এগারো.
সকল বাঁধা-বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে বিচারপতিদের মধ্যে সর্বপ্রথম প্রয়াত আমিরুল ইসলাম চৌধুরী বাংলায় আদেশ ও রায় প্রদান শুরু করেছিলেন ১৯৮৭ সনে।কিন্তু সেগুলো কোনো আইন সাময়িকীতে প্রকাশ পায় নি। ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও বিচারপতি হামিদুল হক সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নজরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র এবং আব্দুল আজিজ বনাম সেকান্দর আলী মামলায় বাংলায় রায় প্রদান করে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলনের নতুন মাত্রা যোগ করেন।উভয় মামলার রায় প্রচার হয় ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ তারিখে এবং প্রথমটি লিখেন বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও দ্বিতীয়টি লিখেন বিচারপতি হামিদুল হক।এই দু'টি মামলা ৫০ ডিএলআর-এ প্রকাশিত হয়।এই বিচারপতিদ্বয়ের প্রয়াস অনস্বীকার্য। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ২০০টি
মামলার রায় বাংলায় দিয়ে সদিচ্ছার প্রমাণ দেখিয়েছেন। বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন তাঁর কর্মজীবনে কখনো বাংলা ভাষা ছাড়া রায় ও আদেশ লিখেননি। তিনি ইতোমধ্যেই সাত হাজারেরও বেশি রায় ও আদেশ বাংলায় দিয়েছেন। বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালও বাংলায় ৫০-এর অধিক রায় ও আদেশ দিয়েছেন।বিচারপতি জাকির হোসেন, বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল, বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন, বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল করিম, বিচারপতি হামিদুল হক প্রমুখ বিচারপতিগণ অনেক রায় ও আদেশ বাংলায় দিয়েছেন এবং এই গতি চলমান রয়েছে।সম্মানীয় বিচারপতিগণ বাংলা ভাষায় যথার্থ রায় দিয়ে প্রমাণ করেছেন, বাংলা ভাষা আদালতে ব্যবহার করা সম্ভব। সদিচ্ছার ঘাটতি;মানসিক দৈন্যতাই প্রধান অন্তরায়। এসব বাধা-বিপত্তি, প্রতিবন্ধকতা, সীমাবদ্ধকতা দূর করা জরুরি।
বারো.
২০১৪ সালে ০৩ মে এডভোকেট ইউনুস আলী আকন্দ সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন বাস্তবায়নের জন্যে একটি রিট আবেদন করেন। মহামান্য হাইকোর্ট ১৫ মে’র মধ্যে বাংলা ভাষা প্রচলনের নির্দেশনা সরকারকে দেন। বাংলা ভাষা প্রচলনে হাইকোর্ট কর্তৃক এই প্রদত্ত আদেশ বাস্তবায়নে সরকারের অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়।পরবর্তীতে বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেন গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ একটি আদেশ দেন। এবং আদালত নির্দেশনা দেন যে,বাংলা পত্রিকায় বাংলা বিজ্ঞাপন দিতে হবে এবং ইংরেজী পত্রিকায় ইংরেজী বিজ্ঞাপন দিতে পারবে।এছাড়া সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে নির্দেশনা প্রদান করেন।একই বেঞ্চ ইতিপুর্বে এক মাসের মধ্যে সকল বিদেশী ভাষার বিজ্ঞাপন এবং গাড়ীর নেইম প্লেট বাংলায় পরিবর্তনের জন্যে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না,তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারী করে। দুই সপ্তাহের মধ্যে বিবাদী মন্ত্রী পরিষদ সচিব, আইনসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রারকে জবাব দিতে বলা হয়েছিলো।২০১৪ সালে উচ্চ আদালত সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলো,'সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে হবে।’ বহু বছরেও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণ কী?এর উত্তর কারো জানা আছে কিংবা নেই।সদিচ্ছা ও মাঠপর্যায়ে কার্যকর তদারকির অভাবে উপেক্ষিত থেকে গেল উচ্চ আদালতের নির্দেশনা।রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতের দেওয়া রায়ের আদেশে ‘দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার,গাড়ির নম্বর প্লেট,সরকারি দপ্তরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিলো।একই বছরের ১৪ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোকে আদেশটি কার্যকর করতে বলেছিল। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আরেকটি চিঠি দেয়।চিঠিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ইংরেজির স্থলে বাংলায় রূপান্তরের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিলো।সংবাদপত্রে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস এলে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেই যেন দায়িত্ব পালন করে।এর বাইরে সারা বছর উল্লেখযোগ্য দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। এদিকে ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট উচ্চ আদালতের একটি রায়ে মন্তব্য করা হয়েছিলো যে, ‘বাংলা ব্যবহারে দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই।’ ২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছিলো। চিঠিতে উল্লেখ ছিলো ‘সাইনবোর্ড,বিলবোর্ড,ব্যানার ইংরেজির স্থলে বাংলায় প্রতিস্থাপিত হয়েছে বলে দেখা যায় না’ 'এটা বাংলা ভাষা প্রচলন আইন,হাইকোর্টের রুল ও আদেশের পরিপন্থী।’ পরিতাপের বিষয় উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না মানলেও পার পাওয়া যায়। এই সংস্কৃতি ধ্বংসাত্বক।
তেরো.
পৃথিবীর সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখা যায় মাতৃভাষার প্রকৃত গুরুত্ব যাদের যতো অধিক তাঁরা ততো অগ্রগামী। স্বভাষার সমৃদ্ধি করেই বিশ্বের জাতিসমূহ অগ্রসর হয়েছে। চীন, জাপান, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, নেপাল ইত্যাদি দেশ প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নিজ ভাষায় জ্ঞানচর্চার মাধ্যমেই উন্নতির চরম শিখরে তাঁরা। ভাষা শিক্ষাকে প্রসারিত করেছে। ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমেই সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। এসব দেশে বিচার কার্যক্রম তাঁদের মাতৃভাষায় পরিচালিত হয়।
চৌদ্দ.
বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রভাষা’ বাংলা। সংবিধানিকভাবে আদালতের ভাষা বাংলা। ফলে আদালতে বাংলা ভাষার পুরোপুরি ব্যবহার চাই। প্রয়োজনে সরকারি ঘোষণা চাই। ২১ ফেব্রুয়ারি আসলেই ভাষার জন্যে মায়াকান্না– সারাবছর খবর নেই তা হতে পারে না। এর অবসান কবে হবে? যুগের পর যুগ পার হচ্ছে। আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার করতে যেসব বাধা রয়েছে সেসব নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যেভাবে ২০০৭ সালে ১ নভেম্বর ১৩০ বছর পর বিচার বিভাগকে পৃথক করা হয়েছিলো। বিচার ব্যবস্থায় ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে হবে দূর আরও বহুদূর।
লেখক : আইনজীবী