হাওরের কৃষকই স্বয়ংসিদ্ধাঃ কিন্তু পূঁজি-বাজার-অবকাঠামো দেবে কে ?
নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ মে ২০২১, ১১:৫২ অপরাহ্ণ১২ এপ্রিল ২৭ চৈত্র ২৮ বঙ্গাব্দ সোমবার গ্রামের বাড়ি মজলিশপুর থেকে বিপুলের গাড়িতে সুনামগঞ্জের দিকে রওনা হয়েছি। তখনও ধান কাটা-মাড়াই ভালো করে শুরু হয়নি। ঢাকা থেকে পার্টি সভাপতি সেলিমভাই হাওরের ফসলের অবস্থা, কৃষক, ক্ষেতমজুরের চিন্তা ও করণীয় নিয়ে একতা’র ব্যানার হেডলাইন হবে এমন একটি লেখা ১৮ এপ্রিল ছাপার জন্য পাঠাতে বললেন। সুনামগঞ্জ এসে একদিন বিশ্রাম নিয়ে ১৪, ১৫ এপ্রিল বুধ-বৃহস্পতি দু’দিন হাওরে দেখে আসা চিত্র ও খবরাখবর নিয়ে এবং সঞ্চিত অভিজ্ঞতার আলোকে “হাওরের কৃষিঃ ‘অধিক ফলন-দাম কম’ সংকট থেকে মুক্তির পথ” শীর্ষক লিখাটি ১৬ এপ্রিল শুক্রবার ekotamail@gmail.com-এ পাঠালাম। অনেক কষ্ট করে লিখেছি যদি হাওরবাসীর কোনো উপকারে আসে, পড়বেন। এই লেখাটিও তারই ধারাবাহিকতায় হাওরের কৃষকের বর্তমান ধানকাটা-মওসুমের সমস্যাগুলো তুলে ধরছি।
যা বলছিলাম ‘বোরো ফসল’ গ্রামীণ চিন্তায় ‘কপালটোকা’ ‘প্রকৃতির দয়া’র দান। আর দেখুন ক’দিন শহরে কাটিয়ে আবার বাড়ি যাওয়ার আগেই মাত্র ১৮/২০ দিনে কৃষক ধান গোলায় উঠিয়ে নিয়েছে। অবশ্য এখন পর্যন্ত হাওরের কৃষিতে সহায়ক নতুন প্রযুক্তি কিছু যুক্ত হয়েছে ‘রিপার মেশিন’ ‘হারভেস্টার’ মেশিন। এর ফলে হাওরের ধানকাটায় আরও ত্বরাণ্বিত সহায়ক হয়ে অনেক শ্রমঘণ্টা বাঁচিয়ে দিয়েছে। কৃষি-শ্রমিকরা অতীতের দিনে ধানের বোরো, শাইল (টেপি, বাসফুল, লাকাই, আছিম) ইত্যাদি জাত অনুসারে ফলন অনুযায়ী আট, দশ, বারো ভাগে ধান কাটতো। উচ্চ-ফলনশীল ইরি জাতের ধান আসার পর স্বাদের দিক পরিহার করে কেয়ার-ক্ষেতে স্থানীয় জাতের চেয়ে অধিক ফলে বিধায় সব কৃষক ইরিধান চাষ শুরু করে।
কৃষকের সাথে দর কষাকষি করে ভাগালুরাও আগের ভাগগুলির গড় করে দশ ভাগে ধান কাটতে শুরু করে। মানে কেয়ার-প্রতি পনেরো/ষোলমণ ফলন হলে ধান-কাটা-খরচ কেয়ারে দেড়মণ হিসেবে নেওয়ার চল শুরু হয়। বাইরের জেলার বেপারি বা ভাগালু আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেলে নিকটবর্তী টান উপজেলার লোকেরা ধান কাটায় আসতে শুরু করলো। ক’বছর পর থেকেই ভাগে ধান নেওয়া বন্ধ হয়ে যায় কেননা ধান শুকানো, খলা করা, গোলা করে ধান জমানো ঝামেলা মনে করলো। তাছাড়া ভাগের ধান বলে ফরিয়ার কাছে ভালো মানেও বিক্রি হয় না। ফলে কমদামে ধান বিক্রি করাকে লোকসান মনে করে ভাগে ধানকাটা বন্ধ হয়ে গেলো। তারপর থেকে ধানের ভাগে নয়, নগদ টাকায় বাইরের ভাগালুরা ধানকাটার দাবি করে। উব্ধিপানি, শিলাবৃষ্টির ভয়ে পাকাধান ক্ষেতে রাখা বিপজ্জনক মনে করে কৃষক নগদ টাকাতেই ধান কাটাতে বাধ্য হয়। তাহলে কী পর্তায় ফয়সালা হবে এনিয়ে দু’তিন বছর চলে টানাপোড়েন। অর্থ্যাৎ কেয়ার-প্রতি চারজনের মাথাপিছু পাঁচ/ছ’শ’ টাকা রোজিনা হিসাব করে ও কেয়ারে দেড় মণের দাম বাইশ শ’/চব্বিশ শ’ হিসেবে ধরে ভাগালুরা একাট্টা হয়ে যায়। তাদের কথা হলো এই দর দিতেই হবে নয়তো আমরা ধান কাটবো না। এর অর্থ কৃষক তুমি মরো বাঁচো ধানের দাম সরকার থেকে পনেরো শ’ আঠারো শ’ আদায় করতে পারো না পারো আমাকে ধানের দাম মণে দেড় হাজার টাকা পর্তা ফেলে দিতেই হবে। শুরু হলো ধানের ভাগে নয় নগদ টাকায় ধান কাটার নতুন চল্। ২০১৭ সনের হাওর দুর্যোগের পর থেকে বাইরের ভাগালু আর হাওরে ধান কাটতে আসে না। পঞ্চাশ/ষাটের দশক থেকে হাওরে ধানকাটতে ভিন্ন জেলা, পাশের উপজেলার কৃষি-শ্রমিক আসার একটি অধ্যায়ের শেষ হলো।
এখন পাশের এলাকার ভাগালুদের চালু করা রেটে প্রতি গ্রামেই ছোট-বড় ধানকাটা শ্রমিক দল নানা রঙ্গিন পোশাক পড়ে ধান কাটছে। চিন্তা ও হিসাবের বদল হওয়ায় স্থানীয় শ্রমিকদের আয়-রোজগারেরও নতুন একটি পথ আবিষ্কার হলো। ফলে এই গ্রামীণ মজুররা পৌষ-মাঘে এলাকায় ক্ষেতমজুরি করে এবং বৈশাখী ধান কেটে নিজের করা জমা-বর্গা নেওয়া সাত/আট কেয়ার জমিতে পাওয়া শ’/সোয়া শ’ মণ ধানের উৎপাদন ব্যয় কিছুটা কমিয়ে নিতে পারে। যদিও এই গ্রামীণ মজুরদের দু’তিন মাস চিটাগং-টাঙ্গাইল ইত্যাদি অন্য জেলায় কাজে যেতে হয় তবু ভাগালু বা ধানকাটার কাজটি হাতে আসায় স্থানীয় ক্ষেতমজুর জীবনে কিছুটা সুখের সুবাতাস বইছে। বিষাক্ত ২০২০ সনে বিশ্ব-করোনার প্রদুর্ভাবে ধানকাটার শ্রমিকের সংকট বুঝে জেলা প্রশাসন কৃষি-সম্প্রসারণ অফিস প্রমাদ গুণছিলেন। আমরা বিভিন্ন জেলায় ক্ষেতমজুর নেতাদের হাওর এলাকায় ধান কাটায় কৃষিশ্রমিক পাঠাতে আহ্বান করি। রংপুর, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জেলার মজুরির সাথে হাওরের মজুরির সমতা নেই বিধায় শ্রমিক আসে নাই। সেই সময় জেলা প্রশাসককে জেলায় ধানের ভাগে মোট সোয়া লাখটন ধানের সরকারি মূল্য তিন শ’ বারো কোটি টাকার বিনিময়ে মাত্র পঞ্চাশ কোটি টাকার করোনা-ত্রাণ ঘোষণা করতে আমরা সুপারিশ করি। তাতে অনেক কর্মহীন মানুষও চাল-ডাল রেশনিংয়ের লোভে এ তালিকায় নাম লিখাবে। বুঝাতে চেষ্টা করলাম প্রতি গ্রামে গড়ে শঁচিশ/আঠাশ জন কৃষি-শ্রমিক হিসেবে আশি/বিরাশি হাজার ধানকাটা শ্রমিক স্থায়ীভাবে জেলায় থাকবে। সাবেক ডিসি সাহেব তখন ‘পঞ্চাশ কোটি বড় বেশি’ টাকা বলে নাকচ করে বিষয়টি নিয়ে অপারগতা প্রকাশ করলেন। কথায় আছে– শূণ্যস্থান অপূর্ণ থাকে না, আজ স্থানীয় কৃষি-শ্রমিকরা তা পূরণ করলো।
এবারে হাওরে মেশিনে ধানকাটার নতুনত্ব দেখা দিলেও ভাগালুর ধানকাটার বাইশ শ’/চব্বিশ শ’ ও মাড়াই বাবদ পাঁচ/ছ’ শ’ মিলে যে তিন হাজার টাকার পর্তা ছিলো কৃষকের ঘাড়ে ঠিকই আগের পর্তাই চেপে বসে আছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী তা কমে দু’হাজার/দেড় হাজারে নামে নাই। মোট গৃহস্থিতে ধানের উৎপাদন ব্যয় কেয়ারপ্রতি সাত হাজার থেকে কমে পাঁচ/ছ’হাজারে নেমে আসে নাই ফলে উৎপাদন ব্যয় মণ-প্রতি সাড়ে নয় শ’ হাজার টাকাই রয়ে গেলো।
নতুন প্রযুক্তিকে সরকারি প্রণোদনায় সহজ শর্তে কৃষককে ধান-উৎপাদন সরঞ্জাম ভাড়ায় নিতে ব্যবস্থা করে উৎপাদন ব্যয় চার হাজারকে তিন হাজারে, তিন হাজার থেকে দুই হাজারে নামিয়ে আনতে পারলে ধানের ক্রয়মূল্যও কমিয়ে আনা সম্ভব।
নয়তো এই যন্ত্রদানবীয় কৃষিতে আগামীর কৃষির পরিবর্তন আসবে না। আগামী কৃষিকে উন্নত প্রযুক্তি সহযোগে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। দেশে চা-শিল্প, পোশাক-শিল্প, বস্ত্র-শিল্প, সাবান-শিল্প হতে পারে ফসল-শিল্প হতে পারে না কেন ? রাষ্ট্র তো কৃষকের এই বাম্পার ফলন নিয়েই বড় গলায় বুক ফুলিয়ে মুখ ফুলিয়ে কথা বলে। তাহলে উৎপাদান ব্যয় কমিয়ে ধানের সরকারি দাম বাড়িয়ে কৃষিকে লাভজনক ইন্ডাস্ট্রিতে রূপান্তর করার চিন্তা হচ্ছে না কেন ? তা না করতে পারলে কিছুতেই হাওরের কৃষি, কৃষক, হাওরবসতি টিকবে না। হাওরে জীবনের এক কঠিন শূণ্যতা দেখা দেবে। গত চার চারটি সোনার বৈশাখ দেখেছেন। আমার পঁয়ষট্টি বছর বয়সে একনাগারে চার চারটি এমন খরা-শুকনা বছর দেখি নাই বড়দের কাছেও শুনি নাই।
বৈশাখের আসল কষ্টের রূপ তো দেখেন নাই তা দেখা যায় কচইরা বা বৃষ্টি-বাদলের বছরগুলিতে। সারা বছরের শ্রম-ঘাম-অর্থ ‘জমি নামক পানি’তে ঢেলে গরুর চেয়েও অধম হয়ে খেটে কৃষককে যে কী অবর্ণনীয় কষ্ট-যন্ত্রনা পোহাতে হয় তা, না দেখলে বুঝবেন না। আর আপনারা যারা পরিকল্পনাকারী দেখবেনইবা কী করে, থাকেন তো শহরে, টানে, কল্পনা করে পরিকল্পনা করেন ! তাতে হবে না। বাস্তবতা বুঝতে চাইলে যথাস্থানে পরিদর্শনপূর্বক আবিষ্কার করুন ঝড়-বৃষ্টি-বাদলের বৈশাখে কৃষকের উদ্ধারের উপায় কী হতে পারে !
তাই বলছি যদি প্রকৃতি অনুকূলে থাকে, কৃষক কেন পারবে না বিশ/পঁচিশ দিনে ফসল তুলতে ! কৃষক তো একাজে জন্ম-জন্মান্তরের পারদর্শী। হাওরের কৃষক স্বয়ংসিদ্ধ, কিন্তু পূঁজি-বাজার-অবকাঠামো তো নেই ! দিনে দিয়ে গেলে, প্রকৃতি দিয়ে গেলে কৃষক এ কাজে জীবন-ভর পটু। কৃষক, সাড়ে ছ’ফুট মানুষটির পাশে বসে খেয়ে দেখুন আপনার চারগুণ খাবে, ওজন নিয়ে দেখুন পঞ্চান্ন বছরেও পঁয়ষট্টি কেজিও ছাড়ায়নি। দেড়মণি বস্তাটা একটানে মাথায় তুলে নেয়, দেখতে যেন ইস্পাতের চেহারা। এমন কৃষক দেখেছেন ? পঁচাশি বছর বয়স, শার্টের সাইট-পকেট ভর্তি ধান—। উঠানে, আনাচে-কানাচে দোকান ঘরে আসতে যেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ধান দেখে আতকে ওঠে এ্যাঁ ধান ! কী করা উচিৎ ! পকেটে ভরেছে, রাতে ঘুমালে বৃদ্ধা কৃষক বধূ পকেট থেকে বের করে অট্টহাসিতে তিরস্কার করছে । কেন ? সারা জীবনে বুঝেছে ধান ফলাতে কী কষ্ট কী জীবন-পণ যন্ত্রনা ! তার ভাবনা–এ তো মানবের রিজিক একে অবমাননা করা যায় না। আপনি আমি কী করি ? টাকাকে পয়সাও মনে করি না কেননা সহজে কামাই হয় কিনা ! কৃষি-শ্রম দিতে হয় না তো তাই মূল্য কম। এর নাম ‘কৃষক’ যে আফালে ঢেউভাঙ্গা, কালবৈশাখীর ঝড়ভাঙ্গা, শিলাবৃষ্টির সহস্রাঘাতে, বজ্রপাতের হাজার-ভোল্ট বিদ্যোতের ছোবল ডিঙ্গিয়ে, বজ্রকঠিন দৃঢ়তায় টিকে থাকা ‘গ্রামীণ মানুষ’। এসব কিছু তার কাছে আপদ, কেননা সে নিজেই আদ্যোপান্ত একটা বিপদ।
এবছর শতাব্দীসেরা কেমন হিসেবি বৈশাখ গেছে দেখুন, দিনে যদিও প্রচণ্ড রোদ, রাতে কিঞ্চিত ঝড়-বৃষ্টি হয়ে ভারসাম্য রক্ষা করেছে। ক’দিন টানা গরম তো এক ফসলা বৃষ্টি দিয়ে প্রকৃতি মাঝে মধ্যেই ভূ-তল ঠাণ্ডা করে দিয়েছে। হাওরের কৃষকের জন্য এই তো যথেষ্ট। এর বেশি গ্রামীণ জনপদের, কৃষকের আর চাওয়ার নেই, চেয়ে অভ্যেসও নেই। বাকি যা পেলে নির্বিঘ্নে নতুন ধান ঘরে তোলার কষ্টটা সর্বাংশে স্বার্থক হতো তা হলো ধানের অাশানুরূপ দাম। এখানেই ভবানী। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করেও মহাজনের যমতাড়নায় সাড়ে আট শ’ টাকায় ধান বেচতে হচ্ছে, মাসেক পরেই যে ধান হাজার/বারো শ’ টাকা হবে। এটাই আফসোসের বিষয়।
আঠারো সনে এক ডিসি সাহেবও এই কথাটি বলেছেন কৃষক কমদামে ধান বিক্রি না করে গোলাজাত করে চড়াদামে বিক্রয় করলেই তো পারে। এখন বলুন আর কোথায় কী বলবেন ! জেলা-কর্তার ধারনা কৃষকরা না বুঝে শখের বশেই মাড়ারতল থেকে ভেজাধান কমদামে বিক্রি করে। অপরদিকে দেখুন কৃষকের নামে ব্যাংক আছে ‘কৃষি ব্যাংক’, লাভের জন্য লগ্নিকারি আরও অনেক ব্যাংক ঋণদানকারি প্রতিষ্ঠান আছে। এতসব থাকতেও কৃষককে কেন যে ‘মহাজন নামক যমদূতে’র দ্বারস্থ হতে হয় এটা আমার ডিসি’ সাহেবরা জানেন না জানার বুঝার চেষ্টাও করেন না। একজন কৃষক ব্যাংকের ঋণ পেতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে হাটাহাটি শুরু করে খিরাজ দিয়েও টাকা পেতে ফেব্রুয়ারি পার হয়ে যায়। ইতোমধ্যে ক্ষেত রক্ষা করতে মহাজনের ‘চাওয়ামাত্র পাওয়া’ ঋণ নিয়ে সর্বনাশের হাত থেকে ক্ষেত রক্ষা করে, পরে পাওয়া ব্যাংকের ঋণটা ‘গোদের উপর বিষফোরা’র মতো বাড়তি যন্ত্রনা হয়েই কাঁধে বিরাজ করে। পরে ‘যতটাকা ততব্যয়’ হিসেবে আজেবাজে কাজে বে-হিসেবি খরচই হয়, গৃহস্থির মূল কাজে লাগে না। এখানে জেলা প্রশাসক, প্রশাসনের কোনো কর্তব্য বা আন্তরিক তদারকি লক্ষ করা যায় না। অথচ কৃষকের নামে ‘ব্যাংক একাউন্ট’ আছে, ‘কৃষিকার্ড’ আছে, ওয়ার্ডে ‘ওয়ার্ড মেম্বর’, চেয়ারম্যান’, ‘ইউনিয়ন কৃষি-কর্মকর্তা’ পাইক-পেয়াদা সবই আছে। শুধু নেই কৃষকের প্রতি আন্তরিক কর্তব্যজ্ঞান, দরদ, সদিচ্ছা।
হাওরের বোরো ফসল ‘আবহাওয়া ও বৃষ্টি’-নির্ভর ফসল। তালে-ঘাতে বৃষ্টি হলে কৃষক তেমন যত্ন না নিলেও ফসল হবেই। এবছর ফসলের ফলন টাইমে যথা-সময়ে বৃষ্টি প্রচুর-পরিমানে হয়নি কার্তিক-মাসে বৃষ্টি একটু হয়েছে তবে আশানুরূপ হয়নি। খনা বলেন ‘মাঘে-মেঘে দেখা হলে ভালো’ তাও হয়নি, ফাল্গুনের দিকে শেষ বৃষ্টি হয়। তারপর টানা দেড়মাস বিলম্বে ফসল যায় যায় অবস্থায় চৈত্রের মাঝা-মাঝিতে একটু ‘বৃষ্টির শান্তির বারি’তে ফসলটা একরকম টিকে যায়। তাতেও নিয়মের অতিরিক্ত ফসলই ১৪২৮ বঙ্গাব্দে হয়েছে যদি খনার-বচনের নিয়মে বৃষ্টি হতো ফলন্তি ধান ক্ষেতে ধরতো না।
এত অনুকূল বৈশাখেও যে যে প্রতিকূলতাগুলি গোটা হাওরের কৃষি-ব্যবস্থাকে পেছনে ফেলে রেখেছে তা আলোচনা করছি। তা হলো হাওরে মন্দাতা আমলের যাতায়াতের পথ বা হাওরের গোপাট। হাওরে কৃষিক্ষেত্রে ধানচাষ শুরু হয়েছে এক অজানা৷ সময় থেকে। সেই সময়কার কৃৃষকের কষ্টকর চলাচলে গরু-মহিষের পায়ের ধারালো খুরে যে রাস্তা তৈরি হয়েছিলো এখনও তাই আছে। পানিসেচের ইঞ্জিন, কলের লাঙ্গল, ইদানিংয়ের ধানকাটা যন্ত্র, মাড়াই কল ইত্যাদি মাঠ পর্যায়ে আসতে আবিষ্কার হতে না হয় সময় লেগেছে। তাই বলে রাস্তা পাকাকরণ তো বর্তমান সময়ের হিসেবে অনেক পুরোনো ব্যাপার। দেখুন দেশে গাড়ি চলার রাস্তা হয়, হাওর থেকে পেটের রিজিক ‘ধান’ আনার কোনো পাকা রাস্তা হয় না।
২০১২ সনে সুনামগঞ্জের স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকার আয়োজনে “জেলার “সমস্যা-সম্ভাবনা- করণীয়” নিয়ে জবানদিহিমূলক এক বৃহৎ গোলটেবিল আলোচনায় জেলার সরকারি, বে-সরকারি, আধা-সরকারি সব অফিসের প্রধান-প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। আলোচনায় আমার প্রসঙ্গ ছিলো হাওরের গোপাট পাকা-রাস্তায় পরিণত করণ। সম্ভবত আমিই প্রথম ইস্টিমেট দিয়ে দেখিয়েছিলাম সুনামগঞ্জ জেলায় মাত্র আড়াই শ’ থেকে সাড়ে তিন শ’ কিঃ মিঃ গোপাট পাকা করে দিলেই সারা জেলার হাওরের ধান পরিবহণ-যাতায়াতের সার্বিক সুবিধা ও কৃষক সরাসরি উপকৃত হবে। বরাদ্দের ব্যাপারে দেখিয়েছিলাম– ভাটির জেলা সুনামগঞ্জে উঁচু রাস্তা করতে মাইলে এককোটি টাকা ব্যয় হয়ে থাকে। কিন্তু গোপাট তো হালকা রাস্তা, তাই বড় রাস্তার হিসেবে এই খরচে তিনগুণ গোপাট পাকা হবে। সে হিসেবে পঁচাত্তর/আশি কোটি টাকায় গোটা জেলার গোপাট পাকা করা যাবে। কৃষক কেউ উপস্থিত ছিলো না তবু এমন দাবিও যে করা যায়, করা উচিৎ সেদিনের ধন্যবাদ পাওয়া থেকেই বুঝেছিলাম। কিন্তু কী হবে ধন্যবাদে ? টক খাবো আমি ধন্যবাদ দিয়ে, কাজ যদি না হয় ! সত্যি এখনও টকই গিলছি। আজকের পরিকল্পনামন্ত্রী তখন অর্থ-প্রতিমন্ত্রী হয়ে উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে কোনো সুফল তো দশ বছরেও দেখলাম না। আমার একটি ছোট্ট হাওর, কাইলানীর মাত্র চব্বিশ বর্গ কিঃমিঃ এরিয়া, আমার হিসাবে একুশ কিঃমিঃ গোপাট পাকা করলেই হয়। জাইকার বিভাগীয় প্রধানের সাথে কথা বলে উপজেলা ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে তিন বছরে সার্ভেটাই করাতে পারছি না। তাই বলি টাকা তো দেশে কম লোপাট হচ্ছে না কিন্তু দেশের খাদ্য মাঠ থেকে কৃষকের গোলায় তুলতে হাওরের গোপাটগুলি পাকা হতে এত দেরির মূলে অবজ্ঞা অমনযোগিতা ছাড়া তো আর কিছুই নয়।
একনাগারে গত চারটি বৈশাখ কৃষকের মনের যতটুকু চাওয়া তার চেয়েও বেশি দিয়েছে প্রকৃতি, দিচ্ছে না শুধু নিজের দেশ, রাষ্ট্র, শুভাকাঙ্ক্ষী মহল। তাই কৃষক ব্যাংক থেকে কীভাবে সহজে ঋণ পাবে, সমানুপাতে মজুর ইনসাফের মজুরি পাবে, সে অনুপাতে ফসলের উপযুক্ত দাম কীভাবে পাওয়া যাবে, কীভাবে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন খরচ কিছুটা কমানো যাবে, দুর্গম হাওরে গোপাটগুলি পাকা করে নতুন প্রযুক্তির পরিবহণ-উপযোগী রাস্তা তো রাষ্ট্রকেই করতে হবে। এসব ব্যবস্থা যদি যথা-সম্ভব থাকতো তাহলে গত ক’বছরে কৃষক পুরোনো ঋণমুক্ত হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে যেতে পারতো।
লেখকঃ অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার, সভাপতি, সিপিবি, সুনামগঞ্জ জেলা।