আমার দেখা বিজয়ের কিছু স্মৃতি
নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ডিসেম্বর ২০২১, ১:২৭ অপরাহ্ণএবারের বিজয় দিবস ২০২১ সাল বাঙালি জাতির কাছে এক ঐতিহাসিক চিরস্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে। কেননা, আমরা এবার এক সাথে বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্ম উৎসব সারা বাংলাদেশব্যাপী বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে পালন করেছি।
কিন্তু এই বিজয় এমনি এমনি আসেনি। এই বিজয় এসেছে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে এই বিজয় আনতে গিয়ে কত মা তার প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে ফেলেছেন চিরদিনের জন্য। কত বোন হারিয়েছেন তার ভাইকে, কত বন্ধু হারিয়েছেন তার প্রিয় বন্ধুকে। কত লোক মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে চিরতরে হারিয়েছেন হাত, পা, চোখ। কত কন্যা, জায়া, জননীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আজকের এই বিজয় উৎসব। তিরিশ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই লাল, সবুজ পতাকা আমরা আজ নিজেদের করে পেয়েছি। পূর্ব দিগন্তে বাংলাদেশ নামটি রক্তলাল অক্ষরে ফুটে ওঠে।
বিজয়ের এই সুবর্ণ জয়ন্তীতে আমার দেখা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এবং তার পরের দিনগুলোর কিছু স্মৃতি আপনাদের কাছে তুলে ধরছি।
১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা জিন্দাবাজার পয়েন্টে দেখি মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের বিজয় উল্লাস। বেলা বাড়ার সাথে সাথে জিন্দাবাজারের রাস্তা ধরে রাইফেল কাঁধে মুক্তিযোদ্ধাদের মিছিল করে যেতে, আর কন্ঠে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান। অনেকেই ভাই, বন্ধু, পাড়া-পড়শির সাথে হাত মিলাচ্ছে, বুকের মধ্যে জড়িয়ে স্বজন হারানোর বেদনায় ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সদস্যরাও আমাদের দিকে হাত নেড়ে বিজয় উল্লাস প্রকাশ করছে। একটু পরে দেখি একটি খোলা ভারতীয় আর্মির ভ্যানে একজন ভারতীয় সৈন্যের লাশ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় পতাকা আর ফুলে ফুলে ঢাকা ছিল তার মরদেহ। পরে জেনেছি তিনি ছিলেন ভারতীয় আর্মির একজন উচ্চপদস্থ শিখ অফিসার।
তারপর আমি খোঁজ নিতে যাই জিন্দাবাজার গদা বাবুর বাসায়। বাড়ির মধ্যে ঘাস, ইট, পাথর ময়লা জমে একাকার। সমস্ত বাড়ির দামী জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে গেছে আশপাশের লোকেরা। গদা বাবু ছিলেন নিঃসন্তান, স্ত্রীকে নিয়ে জিন্দাবাজার কুরিটোলায় বসবাস করতেন। ছোট বেলায় মায়ের সাথে তাদের বাসায় কত যেতাম। গদা বাবুর স্ত্রীকে আমি জৈঠিমা বলে ডাকতাম। আমাকে গেলেই নারিকেলের নাড়ু খেতে দিতেন। দুজনের বয়স ছিল তখন সত্তরের কাছাকাছি। গদা বাবু একজন জ্যোতিষ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। ১০ ডিসেম্বর গদা বাবু উনার স্ত্রী এবং জল্লারপারের মনীষা ভক্ত ও দাড়িয়াপাড়ার নিবারণ দাশকে রাতে নিজ নিজ বাড়ি থেকে চিহ্নিত রাজাকার ও পাকিস্তানি আর্মিরা তুলে নিয়ে যায়। তারপরে দাড়িয়াপাড়া রসময় হাইস্কুলে গুলি করে হত্যা করে নির্মমভাবে। এই চারজন শহীদের কথা কোন গবেষক তাদের লেখায় তুলে ধরতে পারেননি। এই এলাকায় কিছু মানুষ ছাড়া অনেকেই জানে না, তাদের এই করুণ মৃত্যুর কথা।
তারপর হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি বারুতখানায়। সেখানে এসে দেখি ভারতীয় হেলিকপ্টার থেকে ভুল করে একটি বোমা ফেলে দেওয়া হয়েছিল একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে। বোমাটি সেখানে পড়ে একটি বড় ধরনের গর্ত তৈরি হয়ে যায়। পরবর্তীকালে সেখানে একটি পুকুর হয়ে যায়। সেখানে অনেক মানুষের ভিড় সবাই দেখছে, কথা বলছে যুদ্ধের ভয়াবতা নিয়ে। অনেককেই বলতে শুনেছি যে বোমাটি ফেলার কথা ছিল নয়াসড়ক খাঞ্চাঞ্জি বাড়িতে, সেখানে তখন পাকিস্তানিদের বড় একটা ক্যাম্প ছিল। কিন্তু সেখানে না পড়ে বোমাটি বারুতখানার ঐ পরিত্যক্ত বাড়িতে পড়ে যায়।
আমার দেখা সবচেয়ে মর্মান্তিক, বেদনাদায়ক এবং দুঃখজনক যে দৃশ্যগুলি দেখেছি যা দেখে সেদিন আমি অঝোরে কেঁদেছি। আজও আমার মনে কষ্ট দেয় সেই সব কন্যা, জায়া, জননীর সম্ভ্রম হারানোদের করুণ আর্তচিৎকার। কেউ কেউ নির্বাক হয়ে চেয়ে আছে। অব্যক্ত যন্ত্রণায় কারো দু’চোখ ভরে জল পড়ছে। কেউ বা পাগলের মত আচরণ করছে। যুদ্ধের এই নয় মাস আমাদের এইসব মা-বোনরা বন্দী ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে, ব্যাংকারে বিভীষিকাময় নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে প্রতিটি মুহূর্ত। কারো শরীরে কোন কাপড় ছিল না। আমি তাদের দেখেছি ১৭ ডিসেম্বর সিলেট মাতৃমঙ্গল হাসপাতালে। তাদের এই করুণ অবস্থা দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। আজও সেই সব দৃশ্য মনে পড়লে মনের অজান্তে আমার চোখ জলে ভরে যায়।
আমি এইসব সম্ভ্রম হারানো বীরাঙ্গনাদের দেখেছিলাম আমার মায়ের সাথে গিয়ে। যেহেতু আমার মা ছিলেন নারীমুক্তি আন্দোলনের নারী নেত্রী সেই সুবাদে আমি মা’র সাথে মাতৃমঙ্গলে গিয়ে এসব দেখি। মা সহ আরও অনেক মহিলা নেত্রী তাদের দেখতে যান।
আমি দেখলাম রেডক্রসের এম্বুলেন্স করে এইসব মা-বোনদের নিয়ে আসতে। আসার সাথে সাথে তাদের মাতৃমঙ্গলের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাদের শরীরে নয় মাসের নরপশুদের নির্যাতনের চিহ্ন দগদগে ঘা হয়ে ফুটে উঠেছে। কেউ কেউ লজ্জায় মুখ ঢেকে চিৎকার করে কাঁদছে। আমার মা সহ অন্যরা তাদের পরম মমতায় বুকের মাঝে আগলে ধরে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছেন। তখন সেখানে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। অনেকে এসেছেন তাদের মেয়েদের সন্ধানে, অনেকেই তখন তাদের মেয়েদের পেয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বুক চাপড়ে চিৎকার করে কাঁদছেন। এইসব দেখে সেখানে অনেক মানুষের চোখে জল আসতে দেখেছি। মাতৃমঙ্গল তখন অনেক মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল। অনেকেই তাদের মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন। তখন রাস্তা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ মিছিল করে যাচ্ছে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে মানুষ তাদের ফুল ছিটিয়ে বরণ করে নিচ্ছে।
১৮ তারিখ মা’র সাথে মাতৃমঙ্গল ভিতরের একটি ওয়ার্ডে গিয়ে দেখি অনেকগুলো দোলনায় শিশুরা শুয়ে আছে। কেউ কেউ হাত, পা ছুড়ে কাঁদছে, কেউ বা আনমনে খেলছে। আর এইসব শিশুরা ছিল সব যুদ্ধ শিশু।
পরবর্তীকালে এইসব যুদ্ধ শিশুদের রেডক্রসের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিশেষ করে কানাডা, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস প্রভৃতি দেশের অনেক নিঃসন্তান দম্পতি এইসব শিশুদের দত্তক হিসেবে নিয়ে যায়। যা আজ আমরা মাঝে মাঝে টেলিভিশন ও সংবাদ পত্রের মাধ্যমে জানতে পারি যে, আজ এইসব যুদ্ধ শিশু বড় হয়ে তাদের আসল সত্য জেনে বাংলাদেশে আসছে এবং তাদের জন্মদায়িনী মাকে খুঁজছে। ইতিমধ্যেই অনেকেই দীর্ঘদিন এই দেশে থেকে অনুসন্ধান করে নিজের মাকে খুঁজে পেয়েছে। অনেকেই আজও খুঁজে ফিরছে।
আবার অনেক শিশুকে বাংলাদেশের শিশু নিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। আর সম্ভ্রম হারানো অনেক নারী আর নিজ সংসারে ফিরে যেতে পারেননি। অনেকেই তখন তাদের মা, বাবা, স্বামীরা সামাজিক লোক লজ্জার ভয়ে তাদের ঘরে ঠাঁই দেয়নি, আর এসব সংসার হারা নারীদের পূনর্বাসন কেন্দ্র তৈরি করে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং তাদের জন্য নারী পূনর্বাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। যেখানে তাদের নানামুখী কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে দিতে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসে আমাদের মা-বোনদের অত্যাচারের করুণ কাহিনী শুনে শিশুর মত কেঁদে উঠেন। পরবর্তী কালে বঙ্গবন্ধু এইসব সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের আহবান জানান এইসব মেয়েদের বিয়ে করতে। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণায় অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক যুবকরা তাদের বিয়ে করে নিয়ে যায়। আমার জানামতে অনেক মেয়েকে তখন লন্ডন এবং হিন্দু মেয়েদের পাশের দেশ ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং সেখানেই তাদের বিয়ে হয়ে সংসার করছে। তারা কেউই আর এদেশে আসেননি।
আজ বিজয়ের এই সুবর্ণ জয়ন্তী পালন উৎসবে বার বার মনে পড়ছে সেইসব বীরাঙ্গনা মা-বোনদের কথা, যাদের দেশের জন্য এই আত্মত্যাগ আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আজকে বিজয় উৎসব পালন করছি।
লেখক : কলামিস্ট।
এবিএ/২০ ডিসেম্বর